আইরিশদের দেশ আয়ারল্যান্ড
গির্জার শহর ডাবলিন
গানের সুরের মূর্ছনা মনকে বেশ নাড়া দেয় ……
-আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ভ্রমণ বিষয়ক লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন
আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দারাই হল আইরিশ। তাই আয়ারল্যান্ডকে বলা হয় আইরিশদের দেশ। একসময় আইরিশরা ছিল গরিব। তখন তো জগৎ জোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে গিয়ে নানা রকম কাজ খুঁজে বেড়াত আয়ারল্যান্ডের তরুণ -তরুণীরা। আইরিশ পুরুষদের অনেকেই সৈনিক হয়। আইরিশ মেয়েদের অনেকেই নার্স পেশা বেছে নেন।
আইরিশ মেয়েদের দ্বারা একবার যারা সেবা পান, তারা বলতে বাধ্য হন, ‘আইরিশ নার্সের যত্নের কথা চিরকাল মনে রাখব।’
আইরিশ মেয়েরা দেখতে খুব সুন্দর। আয়ারল্যান্ডের লোকেরা মনে করে যেহেতু তাদের দেশে খুব বৃষ্টিপাত হয় সেজন্য ঘাস ও গাছপালা যেমন চিরসবুজ তেমনই এখানের মেয়েদের ত্বকও সুন্দর ও মসৃণ।
‘গোরা’ ছবিটি দেখে আইরিশদের দেশ আয়ারল্যান্ডের প্রতি উষ্ণ ভালবাসা জন্মায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস নিয়ে নির্মিত নরেশচন্দ্র মিত্র পরিচালিত সেই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হল ‘গোরা’ নামের যুবকটি। গোরা মুলত ছিলেন একজন আইরিশম্যানের পুত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উত্তর প্রদেশের এটওয়াতে থাকতেন আইরিশ দম্পতি। যুদ্ধে সেই দম্পতি মারা গেলেও তাদের শিশুপুত্রটি দৈবক্রমে বেঁচে যায়। পরে এক বাঙালি নারী সেই আইরিশ পুত্রটিকে পথে পেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে লালনপালন করে বড় করেছিলেন। ‘গোরা’ ছবিটি দেখে আইরিশদের প্রতি জানার কৌতূহল জাগে বালক বয়স থেকেই। আর আইরিশদের দেশ আয়ারল্যান্ড দেখার আগ্রহ হৃদয়ের অতল গভীরে পুঞ্জীভূত হয়েছিল সেই থেকে।
ডাবলিন –
ইংল্যান্ডের পশ্চিমে অবস্থিত দ্বীপ আয়ারল্যান্ড। আর এই আয়ারল্যান্ডের রাজধানী হল ‘ডাবলিন’। লিফি নদীর ওপর অবস্থিত এ মহানগর প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ। ‘ডাবলিন ক্যাসেল’ কিং জন স্থাপন করেছিলেন ১২০৪ সালে। এর আগে এটি যুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদের বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত।
ডাবলিন যেহেতু খ্রিস্টান দেশ তাই এখানে বহু গির্জার ছড়াছড়ি। গির্জাগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল সেন্ট প্যাট্রিক্স ক্যাথিড্রাল ও ক্রাইস্ট চার্চ।
ডাবলিন শহরের প্রধান পথ ওকনেল স্ট্রিট। এর আশেপাশে রয়েছে নানা বিশ্ববিখ্যাত শপিংমল ও বিভিন্ন কার্যালয় যেমন – ব্যাঙ্ক অব আয়ারল্যান্ড, জেনারেল পোস্ট অফিস, অ্যাবি থিয়েটার। অ্যাবি থিয়েটার যা সারাবিশ্বে বিখ্যাত থিয়েটার।
ডাবলিনের রাইটার্স মিউজিয়ামে রয়েছে বিখ্যাত আইরিশ লেখকের ভাস্কর্য ও তাদের বহু খ্যাতিপ্রাপ্ত রচনা। এখানের ন্যাশনাল গ্যালারিতে আয়ারল্যান্ডের সম্পূর্ণ ইতিহাস অঙ্কিত রয়েছে।
ডাবলিন থেকে একটু দূরেই ল্যারাটাউন নামে একটি ছোট্ট শহর আছে। জায়গাটা নামেই শহর, কয়েকটি খাবারের দোকান বা রেস্তোরাঁ, গুটিকয়েক বিভিন্ন সামগ্রী বেচাবিক্রির দোকান, কয়েকটি পেট্রোল পাম্প ও কিছু বাড়িঘর রয়েছে। একটি গীর্জাকে কেন্দ্র করে এসব অবস্থিত এবং প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, এ গির্জা স্থাপন করেছিলেন এক খ্রিস্টান সাধু। তিনি এখানে এসে শান্তি খুঁজে পান এবং সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। তাই এ স্থানটি পরবর্তীতে একটি তীর্থস্থান হয়ে ওঠে।
ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডের মতো আয়ারল্যান্ড ছিল এককালের গ্রেট ব্রিটেনের একটা অংশ। ১৯১৬ সালে বিদ্রোহী আয়ারল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল। এরও বহু বছর আগে স্ক্যানডিনেভিয়ার জলদস্যুরা নবম থেকে একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল এবং এর পাশাপাশি বিধ্বংসী কাজকর্ম চালিয়েছিল।
নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের এই জলদস্যুদের বলা হয় ভাইকিং। এরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল।
আয়ারল্যান্ডও এই আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এরা ডাবলিন, লিমেরিক এবং ওয়াটারফোর্ডে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের অন্যতম আকর্ষণ ডাবলিন ক্যাসেল । ধনুকাকৃতির খিলানযুক্ত বিচিত্র নকশায় তৈরি এ দুর্গটি দেখতে অতি মনোরম। ভাইকিং রাজাদের একশোর বেশি রাজসনদ, প্রচুর তরবারি এবং মল্লযোদ্ধাদের গদা সংরক্ষিত আছে এখানে। প্রবেশদ্বারে সোনালী গম্বুজ, খোদাই করা চিত্রিত দেওয়াল, ভাস্কর্য, মার্বেল এবং রঙিন পাথরের জোড়া মেঝ দেখতে দেখতে মোহিত হতে হয়।
মিউজিয়ামের বাইরে দেখার আছে – বেশ কিছু উপসনালয়, বাগান, প্রস্তর মূর্তি, কিছু সমাধিক্ষেত্র।
ডাবলিনের ফেনিক্স পার্ক খুবই আকর্ষণীয়। এই পার্ক বিশ্বের বৃহত্তম শহর কেন্দ্রীক উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং ইউরোপের বৃহত্তম উদ্যান।
লিফি নদীর উত্তর তীরে ১,৭৬০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে ঘন সবুজ তৃণে আচ্ছাদিত এই পার্ক। এরমধ্যে রয়েছে ঘোড়দৌড়ের মাঠ, চিড়িয়াখানা, বাঘের প্রজননকেন্দ্র। এই পার্কের মধ্যেই অবস্থিত আইরিশ প্রেসিডেন্টের বাসভবন।
ডাবলিনের চৌরাস্তার মাঝে রযেছে মস্ত বড় এক মনুমেন্ট। অনেক উঁচু বেদির ওপর এক অশ্বারোহী যোদ্ধার মূর্তি স্থাপিত। এই হল ওয়েলিংটন মনুমেন্ট।
ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করেছিলেন ডিউক ওয়েলিংটন।
ডাবলিনে আরও দেখার আছে, যেমন – দীর্ঘতম গির্জা সেন্ট আগস্টিন, জাতীয় গ্রন্থাগার, জাতীয় সংগ্রহশালা, সংসদভবন, ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।
ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৯১ সালে। আয়ারল্যান্ডের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় এটি। এখানে ট্রিনিটি কলেজের পাশেই টেম্পল বার। একটু হেঁটে পশ্চিমে আগালে দেখা যায় ডাবলিনের আধুনিকতম শপিং মল।
ঘর সাজানো থেকে শরীর সাজানো সবরকম পণ্যের বিপুল সমারোহ এখানে। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বারতো আছেই। শহরের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো দু’চারটি তামার গম্বুজ এখনও শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি ধারণ করে আছে।
লন্ডন থেকে সকাল ৯টার ট্রেনে উঠলে বেলা ১টায় ওয়েলসে পৌঁছা যায়। এখানে নেমে আইরিশ সাগর পার হতে হয় জাহাজে। দুপুর ২টায় জাহাজে উঠলে বিকেল ৫টায় পৌঁছা যাবে ডাবলিন বন্দরে। জাহাজের মধ্যে রয়েছে খাদ্য পানীয়ের অনেক দোকান, বার, সিনেমা হল, লাউঞ্জ, ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য কত রকম ব্যবস্থা।
ডাবলিনে রাত যাপন করার জন্য শতাধিক হোটেল রয়েছে।
দেখবেন, খুব মিষ্টিভাষী আইরিশের লোকজন। এদের বাচনভঙ্গিতে যেন একটু কাব্যিক ভাবসাব রয়েছে। চেহারায় ইংরেজদের থেকে এদের আলাদা করে নেওয়া যায়। ডাবলিনের সকল দোকানেই গান বাজে। সেই গানগুলি ভারি মিষ্টি সুরের – যা শুনে মনকে বেশ নাড়া দেয়। দু’দন্ড দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে হবেই।
আয়ারল্যান্ডের বিশেষ দ্রষ্টব্য হল কিলোনি হ্রদ। হ্রদের পাশেই কিলোনি গ্রাম। এই গ্রামে যারা একবার যান তারাই বলেন, কিলোনির মতো এতো সুন্দর গাঁও সহজে মেলে না।
আসলে গোটা আয়ারল্যান্ড অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর, যেন রূপে ঝলমল করে। পাহাড়, হ্রদ, গাছপালা, অরণ্য, সবুজ মাঠ মিলে এক স্বপ্নের দেশ। এখানকার বিস্তীর্ণ হ্রদ লাফলীনের কাকচক্ষু জলের ওপর ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ দেখলে মনে হবে, হীরার বাক্স খোলা। আর তার মধ্যে মণিমুক্তা খচিত নানা রঙের গহনা।
হ্রদের অপর পারে আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, এর নাম হল ‘কারান্টিনো হিল’। পাহাড়টি যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখানের সর্বত্রই যেন সবুজে সবুজে আচ্ছন্ন।
ব্লার্নি ক্যাসেলও দেখবার মতো। ক্যাসেলটি দেখতে গিয়ে সকলেই মুগ্ধ হন। ক্যাসেলটি নিয়ে একটা কথিকা আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র প্রচলিত। তা হল এই ক্যাসলের ওপর কষ্ট করে কেউ যদি একটি কালো রঙের কষ্টিপাথরে চুম্বন করতে পারে তো সে একজন মনভোলানো বক্তা হতে পারবে।
আগা খাঁর ঘোড়া রাখার বিরাট আস্তাবলও ছিল এই আয়ারল্যান্ডে। সমস্ত রেসের ঘোড়া আয়ারল্যান্ডে রাখার দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটা হলো, ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক কম খরচে ঘোড়া রাখা যায়। দ্বিতীয় কারণ হল, আয়ারল্যান্ডে অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা, সে জন্য ঘোড়ার স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশে মানুষের প্রাণের দাম নেই। কিন্তু একটা ভালো রেসের ঘোড়ার দাম পাশ্চাত্য দেশে বহু লক্ষ টাকা।
বালিবোডেন –
আয়ারল্যান্ডের বালিবোডেনও একটি সুন্দর জায়গা। এখানের যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় খুব সুন্দর দৃশ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বালিবোডেনের অনেক যুবক প্রাণ হারায়। কোনো কোনো ঘরে সেই শোক স্মৃতি এখন পর্যন্ত ধরে রাখা হয়েছে।
অনেকগুলি ডেয়ারি ফার্মও আছে বালিবোডেনে। এখান থেকেই ডাবলিন শহরে দুধ সাপ্লাই হয়। প্রতিটি ডেয়ারি ফার্মে ৫০০ করে ভালো গরু রয়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রথায় গো -পালন হয় যাতে গরুর সুস্বাস্থ্য হয়, অনেকদিন বাঁচে এবং ভালো দুধ দেয়। এখানকার গোয়ালারা শিক্ষিত। তারা দুধের নামে ভেজাল করে না – খাঁটি দুধ সরবরাহ করে থাকে।
দি কনেমারা কান্ট্রিসাইড –
আয়ারল্যান্ডের দি কনেমারা কান্ট্রিসাইড মুলত পাহাড়ের জন্য বিখ্যাত। এখানকার প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির ওপর পাহাড় রয়েছে। এছাড়া এটি আয়ারল্যান্ডের পাঁচটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে একটি। এখানে বিশাল পার্কও রয়েছে – সেখানে আছে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ।
দি ক্লিফস অব মহের –
দি ক্লিফস অব মহের – এটি আয়ারল্যান্ডের লাহিনচের উত্তর দিকে অবস্থিত। এটি শুধু আয়ারল্যান্ডের নয়, পুরো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ক্লিফ। এখানে দাঁড়িয়ে আটলান্টিককে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। দি ক্লিফস অব মহেরে রয়েছে এমন কিছু পুরনো দালান, যা দেখতে অনেকটা দুর্গের মতো। যখন আয়ারল্যান্ড প্রতিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল, তখন এখানে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করা হতো।
দি বারেন –
দি বারেন আয়ারল্যান্ডের সাউথ কাউন্টি ক্লেয়ার এবং নর্থ কাউন্টি কেরিতে অবস্থিত। এখানে রয়েছে অনেক চুনাপাথর – যা খুবই আকর্ষণীয়। এসব চুনাপাথর সংগ্রহ ও সংরক্ষণের লোভ সামলাতে পারেন না পর্যটকরা। দি বারেনের গাছও বিশ্ববিখ্যাত – এখানে যত গাছ আছে, পুরো আয়ারল্যান্ডে তা নেই।
আয়ারল্যান্ড হলো মনহারানোর দেশ – যৌবনে আয়ারল্যান্ড গেলে সেখানেই বিয়েশাদি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে কার না মন চায়। যেমন সবুজ সৌন্দর্য আয়ারল্যান্ডের, তেমনই রূপ লাবণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তরুণ -তরুণীরা। তাই বোধহয় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে মন চায় আয়ারল্যান্ডে।