কামরূপ কামাক্ষ্যাকে বলা হয় জাদুটোনার দেশ…। আসামের গৌহাটি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীতের সমতলভূমি থেকে ৫২৫ ফুট উ”চতায় কামরূপ কামাক্ষ্যা। এখানের সারি সারি পর্বতমালা আর ব্রহ্মপুত্রের সৌন্দর্য আপনার মন ভুলিয়ে দিতে পারে।
আসাম শস্য-শ্যামলা। চা-বাগান ব্রহ্মপুত্রের সবুজ অববাহিকা আর কামরূপ কামাক্ষ্যা।
জাদুটোনার দেশ বলা হয় কামরূপ কামাক্ষ্যাকে। চল্লিশ বছর আগেও শোনা যেত, কামরূপ কামাক্ষ্যায় গেলে নাকি সহজে ফিরে আসা যায় না।
সমতল থেকে ৫২৫ ফুট উচ্চতায় কামরূপ কামাক্ষ্যা। কামরূপ কামাক্ষ্যার অন্যতম আকর্ষণ ভক্তদের নৃত্যগীত। দেবী কামাক্ষ্যার মন্দির দেখে বেশি অভিভূত হবেন। এখানে সিংহদ্বার দেখতে পাবেন। সিংহদ্বারের পাশেই শ্মশান এখানকার কোনো পান্ডা কিংবা তার পরিজনের কারো মৃত্যু হলে এই শ্মশানে দাহ করা হয়ে থাকে।
কামরূপ কামাক্ষ্যায় গিয়ে বারবার মনে হবে, কোনো এক রূপকথার গল্পের দেশে এসেছি। যতক্ষণ অবস্থান করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত কী যেন এক রোমাঞ্চকর রহস্য এসে আপনার মনকে ঢেকে দেবে। জানা যায়, তন্ত্রমন্ত্রেই এই কামাক্ষ্যায় সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। এখানের মন্দিরটি নির্মিতও হয়েছে তন্ত্রমন্ত্রের নিয়মানুসারে। কুচবিহারের মহারাজার আমলে এখানের কীর্তিগুলো নির্মিত হয়। প্রধান কীর্তির ওপরে পর পর সাতটি চূড়া রয়েছে।
এখানে সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখে প্রথম প্রথম ভয়-ভয় লাগবে। নাগ-সন্ন্যাসীদের আস্তানায় গেলে বড় বড় সাপ দেখতে পাবেন। পান্ডাদের সঙ্গে গেলে ওরা আপনাকে নাগ-সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাবে। তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করে আপনাকে কিছু খেতে দিলে না-খেয়ে আসতে পারবেন না। তবু খাবেন। অন্তত একটা বিরাট অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসতে তো পারবেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখে দেখে কামাক্ষ্যা পাহাড়ের পূর্ব দিকে আসুন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রাচীন তীর্থ কামরূপ দেখা মানেই জীবনের বিরাট এক স্বপ্ন পূরণ করার মতোই।
পান্ডার সঙ্গে কামরূপ কামাক্ষ্যায় ঃ
গৌহাটিতে রাত ৯টায় পৌঁছানোর কারণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে বাথরুমের যাবতীয় কাজ সেরে নাস্তা খেয়ে চললাম কামাক্ষ্যার মন্দির দেখতে। বাস আঁকাবাঁকা চড়াইপথ ধরে ওপরে ওঠার সময় গৌহাটি শহরকে দেখতে পেলাম। কামাক্ষ্যা গেট থেকে মন্দিরের কাছে যেতে সময় লাগল প্রায় পাঁচ মিনিট। দেখলাম, মন্দির-সংলগ্ন এলাকাটি বহু মানুষের উপ¯ি’তিতে সরগরম হয়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে মন্দিরচত্বরে প্রবেশ করলাম। অভিনব স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি কামাক্ষ্যা মন্দিরগুলোকে ঘিরে আছে সুন্দরভাবে বাঁধানো চাতাল। মন্দিরগাত্রে শোভা পাচ্ছে দেবদেবী এবং নারী-পুরুষের মূর্তি। মন্দির পরিসরে বেশির ভাগ পান্ডা ব্যস্ত তাদের যজমানদের নিয়ে, বাকিরা ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে থেকে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে। কামাক্ষ্যার পান্ডাদের পরনে লাল বসন, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে বড় লাল টিপ। একজন পান্ডাকে দেখে বেশ ভালোই লেগে গেল। বয়স সতেরো হবে, দেখতে ফর্সা-স্লিম বডি। গায়ের রং আপেলের মতো টকটকে। ওর মুখ পানে বারবার তাকিয়ে আছি। এগিয়ে এসে একটু হেসে- মন্দির দেখবেন তো ১০১ টাকার লাইনে দাঁড়ান। তাহলে মন্দিরে প্রবেশ করতে বেশি সময় লাগবে না।
পান্ডা ছেলেটির পিছু পিছু গিয়ে ১০১ টাকার লাইনে দাঁড়ালাম। এ নিয়ে কামরূপ কামাক্ষ্যা ভ্রমণ আমার আটবার হলো। ‘তোমার নাম?’- ‘কৃষ্ণ’। ওকে জিজ্ঞাসা, তুমি কি গান জানো? কৃষ্ণ : এক-আধটু জানি। ফিল্মের প্লেব্যাক সিঙ্গারদের মতো অতোটতো ভালো গাইতে পারব না …।
কৃষ্ণমন্দিরসংলগ্ন সৌভাগ্যকুন্ডে গিয়ে কুন্ডের জল আমার গায়ে ছিটিয়ে দিল। কৃষ্ণের হাত ধরে এবার মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢোকামাত্র এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। ধূপের গন্ধ, ফুলের সৌরভ, নিভে যাওয়া মোমবাতি এবং প্রদীপের কটু গন্ধ, ভক্তদের দেবী বন্দনা, পান্ডাদের মন্ত্রপাঠ, দলবি”িছন্ন মানুষদের ডাকাডাকি, চেঁচামেচি- সব মিলিয়ে মনে হয় এ যেন সম্পূর্ণ এক অন্য জগৎ।
কৃষ্ণর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা- ওর বুকে হাতটা দিয়ে কৃষ্ণ, এই মন্দির সম্পর্কে এবার কিছু বলো। ও জানাল, প্রাকৃতিক এক রহস্যময় গুহাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই কামরূপ কামাক্ষ্যা মন্দির। ওই যে দেখুন, সিংহাসনে আসীন অষ্টধাতুর কামাক্ষ্যা দেবীর মূর্তি।
আরও পড়ুন: আইরিশদের দেশ আয়ারল্যান্ড: গানের সুরের মূর্ছনা মনকে বেশ নাড়া দেয়…
কৃষ্ণকে বললাম, এবার মন্দিরের বাইরে কোথাও গিয়ে বসি। মন্দিরের বাইরে এলাম। দুজনে পায়ে হেঁটে পূর্ব দিকে এগিয়ে চললাম। কৃষ্ণই বলল, প্রকৃতি আর নৈসর্গিক শোভা বুঝি খুব পছন্দ আপনার। ‘হ্যাঁ’ বলতেই কৃষ্ণ বুকে জড়িয়ে- এ এক আনন্দময় পথচলা। চলুন দূরে ব্রহ্মপুত্রের তীরে গিয়ে বসি। হেঁটেই চলছি, দেখি প্রতিটি বাঁকেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবহমান পথ, নদী-তীরবর্তী বিভিন্ন ঘাট এবং গৌহাটি শহরের অনেকটা অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দুজনে এক বটবৃক্ষের তলে এসে বসলাম। কৃষ্ণ আমার হাতে হাত রেখে- আমরা পান্ডা, সারা জীবন ভক্তদের মন্দির দর্শন করিয়ে যাব। এই কাজ নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। মন্দির দর্শনার্থী হিসেবে নয়, আপনাকে কেন জানি ভালো লেগে যাওয়ায় বহুদিন পরে এলাম এই ব্রহ্মপুত্রের তীরে। তা আপনি কোথায় উঠেছেন? বললাম, গৌহাটি শহরে পর্যটনের মোটেলে, এটি রেলস্টেশনের কাছেই। তুমি যাবে?
কৃষ্ণ বলল, খুউব ইচ্ছে হয়। আপনি কি বিয়ার খেতে পছন্দ করেন? বললাম, মাঝেমধ্যে দু-একটা খাই। তোমার কি বিয়ার খেতে ইচ্ছে করছে?
একটু হেসে মুখটা নেড়ে- মনে হয়, এ জীবনে এই প্রথম আপনাকেই বন্ধু হিসেবে পেলাম। আপনি যেখানে উঠেছেন ওখানে কি দু-একদিন থাকা যায় না? বললাম, কেন নয়? কৃষ্ণ হাসল- বিকেলের দিকে যাব। এবার চলুন খেয়েদেয়ে নিই।
একটা আশ্রমে ঢুকতেই দেখি, কয়েকজন পান্ডা বসে গল্প করছে। এক সন্ন্যাসী বসে আছে ‘সাপ’ নিয়ে। বিরাট এক কালনাগিনী দেখে তো ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কৃষ্ণ আমাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে বলল, সাপ দেখে ভয় পাচ্ছেন কেন। আমরা তো সাপ নিয়ে খেলাধুলা করি …। এই বলে কৃষ্ণ সাপটা হাতে নিয়ে নিজ বুকে জড়িয়ে ধরল। তখন তো শুধু তাকিয়ে থাকা। আখড়ায় খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম দুজনে। কৃষ্ণ বলল, চলুন শ্মশানঘাটের পরে এক জঙ্গল রয়েছে- এ জায়গায় গেলে কামরূপ কামাক্ষ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আর ওখানেই তো জাদুটোনা হয়। আর এ জন্যই তো এই কামরূপ কামাক্ষ্যাকে বলা হয় জাদুটোনার দেশ।
কামরূপ কামাক্ষ্যায় প্রতিনিয়ত এরকম দৃশ্য চোখে পড়ে।
শ্মশানঘাটের পাশ থেকে আমরা দুজনে হেঁটে চলছি। কৃষ্ণ বলল, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এ পথে কেউ আর আসতে চায় না। বললাম, কেন?
কৃষ্ণ : শ্মশানে বসে কারা যেন ভয়ভীতি দেখায়। তাদের চেহারা বড়ই বিদঘুটে।
কেমন জানি ভয় ভয় লাগল। ওকে বললাম, জাদুটোনা দেখব না। চলো গৌহাটিতে ফিরে যাই।
কৃষ্ণ ও আমি এবার কামাক্ষ্যা ছেড়ে চললাম গৌহাটির দিকে। কৃষ্ণ জানাল, প্রতিবছর আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে অম্বুবাটি উৎসব হয় এই কামাক্ষ্যায়। ওই উৎসবের সময় কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম ঘটে এই কামাক্ষ্যায়। তখন এলে সব ধরনের আনন্দ করা যায়। আসবেন তো!
বললাম, কেন আসব না। তুমি যে আমার বন্ধু।
কথাটা বলতেই আমার হাতটা টেনে চুমো দিয়ে কৃষ্ণ গান ধরল : ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে এসো গন্ধে বরণে, এসো গানে! এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে, এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে, এসো মুগ্ধ মুদিত দু’নয়নে …।’
সন্ধ্যার কিছু সময় পর এসে পৌঁছলাম গৌহাটিতে। রিকশা নিয়ে কৃষ্ণ আর আমি এলাম মোটেলে। ম্যানেজারকে বলে দ্বি-শয্যাবিশিষ্ট ঘর নিলাম। হোটেল বয় একটু পরে রুমে বিয়ার দিয়ে গেল। টেলিভিশনটা অন করে দিতেই দেখি কৃষ্ণ অবাক। দু’নয়ন ভরে দেখছে। এদিকে বিয়ার গ্লাসে ঢেলে পান করতে লাগল। কৃষ্ণ বলল, বাহ্ আপনি তো বেশ মজার মানুষ। বাংলাদেশে নিয়ে যাবেন তো আমাকে?
বললাম, কেন নয়? কৃষ্ণ হাসল।
দুই দিন হোটেলে থাকল, বেড়াল আমার সঙ্গেই কৃষ্ণ। চলে যাওয়ার কথা বলতেই কৃষ্ণ বলল, আপনাকে বঙ্গাইগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে দেব। বঙ্গাইগাঁওতে আমার পিসির বাড়ি, ওখানে কয়েক দিনের জন্য যাব।
পরদিন সকাল ১১টায় ট্রেন ছাড়ল গৌহাটি রেলস্টেশন থেকে। কামাক্ষ্যা স্টেশনে থামিয়ে আবার চলতে শুরু করল। চলমান ট্রেন থেকেই যেসব পাখি চোখে পড়ল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- মাছরাঙা, কোচবক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, চিল, শঙ্খচিল।
কৃষ্ণ বলল, ওই যে দেখুন ‘দীপর বিল’। এই বিলে রয়েছে রকমারি গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ। বাইরের শোভা দেখতে দেখতে একে একে পেরিয়ে গেলাম আজারা, মিরজা, ধুপধাড়া স্টেশন। ‘পঞ্চরত্ন’ নামে একটি স্টেশন দেখলাম।
এখানে চোখে পড়ল চা-বাগান আর দেখলাম শাল গাছের ছড়াছড়ি।
ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতেই কৃষ্ণ বলল, দেখুন, দেখুন ব্রহ্মপুত্রকে। ওই যে নদীর ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে কত না জেলে নৌকো। ব্রহ্মপুত্র ছাড়িয়ে ট্রেন এগিয়ে চলছে। বারবার চোখে পড়ছিল অসংখ্য গোলাপি রঙের শাপলা ফুল কচুরিপানার আবরণ ভেদ করে মাথা তুলে রয়েছে। আরও দেখলাম সবুজ কৃষিজমি, পুকুর, সবজিবাগান, সুপারিগাছে ঘেরা টিনের ছাদবিশিষ্ট গৃহস্থ বাড়ি …।
একসময় ট্রেন এসে বঙ্গাইগাঁওয়ে কাছে আসতেই কৃষ্ণ বুকে বুক রেখে বলল : ‘আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে অম্বুবাচী উৎসবের সময় আসবেন কিন্তু।’ কথাগুলো শুনে কৃষ্ণর পানে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমি কে, ও’ কে- এ কথা কেন ভাবছে না কৃষ্ণ। দেখি ওই যে কৃষ্ণ চলে যাচ্ছে। ততক্ষণে বঙ্গাইগাঁও রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। আজও প্রশ্ন- কামাক্ষ্যার কৃষ্ণর সঙ্গে আর কি কোনো দিন দেখা হবে?
-লিয়াকত হোসেন খোকন