কুশিয়ারা নদীর এপারে অর্থাৎ পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের জকিগঞ্জ। পূর্ব পাড়ে ভারতের করিমগঞ্জ। খুব সকালে এসে পৌঁছেছি জকিগঞ্জে। ঘন্টা তিনেক সময় বিশ্রাম শেষে ফেসবুকের বন্ধু মেহেবুব চৌধুরীকে বললাম, কুশিয়ারা তীরে চলো। ওখানে কিছু সময় না হয় কাটাব।
একটু হেসে- ” ওই নদীতীরে পর্যাপ্ত পানি থাকায় পাখিরাও সেখানে ফিরেছে। বিকালেই ওখানে পাখিদের ভিড় থাকে। ” মেহেবুব চৌধুরী স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষার্থী। ওর বাড়িতেই উঠলাম। পায়ে হেঁটে এলাম কুশিয়ারা নদীর তীরে। গত রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে এখানে আসা-তারপর ১৫ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ভাবলাম, কী-ই না এক নির্জন বনপথে এলাম। এখানে নেই কোনো কোলাহল। এ নির্জনতায় মন উদাস হয়। বাহ, এখানে তো দোল দিয়ে যায় সোনার বাংলার সবুজের প্রতিচ্ছবি । ঝিরঝির মেঠো হাওয়ায় নদীর বুকে ঢেউয়ের খেলা…।
দেখতে পেলাম তীরে তীরে এখানে কতই না নির্জনতা। রঙিলা নায়ের মাঝি নৌকা বেয়ে বরাক নদীর ওপারে যাচ্ছে, যাদের ভিসা আছে তারাই যাবে ওই যে করিমগঞ্জে। মেহেবুব চৌধুরী বলল, প্লিজ দাঁড়ান দাঁড়ান, কুশিয়ারার তীরে। ছবি তুলব। আপনার পেছনে থাকবে ভারতের করিমগঞ্জ। বললাম, কেন করিমগঞ্জে গিয়ে কি ছবি তুলতে পারি না ?– কেন আপনি কি শোনেননি ফেলানীর কথা। ওপারে গেলে গুলি, স্রেফ গুলি ছুড়বে বিএসএফ। ওর কথাগুলো শুনে বললাম, তাহলে ছবি তোলার কাজ নেই।
হাসল মেহেবুব । -আপনার বুঝি আক্ষেপ হচ্ছে! আক্ষেপ করে কী লাভ। দেখুন দেখুন, কুশিয়ারা নদী। অচেনা এক বৃদ্ধলোক এসে গাইতে লাগল :
দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে
একই তরু শাখা পরে ছিল বাঁধা লীলাভরে
অজানা সে কোন ঝড়ে ভেঙে নিলো বাসাটিরে
বিধাতার অভিশাপ নিয়তির হলো জয়
ছিঁড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয়
ছিল যেথা আলো হাসি ফুলফল মধু বাঁশি
আজি সেথা কিছু নাহি বায়ু কেঁদে যায় নীড়ে
দুটি পাখি তীরে…’
গানটা শেষ হতেই দেখি তার দুই চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। জিজ্ঞাসা, কেন কাঁদছেন ? উঁনি জানালেন, এই জকিগঞ্জে আমার বাড়ি, ওই যে নদীর ওপারে করিমগঞ্জে আমার বহু আত্মীয়-¯^জন রয়েগেছে। যেতে লাগে ১০ কি ১২ মিনিট; কিন্তু যেতে পারছি কোথায় ? করিমগঞ্জ ভারতের আসাম রাজ্যে। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া গেলে গুলি খেতে হবে, নয়তো জেলে যেতে হবে! বড় অসহায় আমরা এই সীমান্তেই বসবাস করছি। মেয়েটা ওই করিমগঞ্জে থাকত, মৃত্যু সংবাদ শুনেও ওকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি। দেখুন কত নিষ্ঠুর আমাদের আইন-কানুন। দেশ ভাগ…।
কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে চললাম। মেহেবুব বলল, দেখুন দেখুন ওই যে শক্সখচিল উড়ে যাচ্ছে করিমগঞ্জের দিকে। বলতে পারেন, ওরা কোন দেশের নাগরিক! ওদের নাগরিকত্ব লাগে না, আইডি কার্ডও লাগে না। ওরা যে স্বাধীন! ইস্ শঙ্খ চিল হলে হয়তো আপনিও এপার থেকে ওপারে যেতে পারতেন।
নদীতীরে এক গাছের তলায় গিয়ে বসলাম। দূর থেকে দেখে যাচ্ছি করিমগঞ্জ। নামটাও বেশ সুন্দর! মেহেবুব বলল, এপাওে ‘জকি’ ওপাওে ‘করিম’। কতই না ওদেও মিল। মানুষ, দেশ আর রাষ্ট্র ওদের মিলনে যেন বাধা হয়ে দাঁড়াল। সে জন্য আজ যে করিমগঞ্জে যেতে পারলেন না। নদী তীর হয়ে হয়ে আমরা এবার উত্তর পশ্চিম দিকে এগোতে লাগলাম। ওই দিকেই তো মেহেবুব চৌধুরীর বাড়ি।
বলল, উত্তরে কানাইঘাট উপজেলা, দক্ষিণে বিয়ানীবাজার। আজ সন্ধ্যার পরে ফুফুবাড়ি নিয়ে যাব। ফুফু একাই থাকেন, তার ছেলে-মেয়ে সবাই থাকে লন্ডন, নিউইয়র্কে। বাড়ি যেন খাঁ-খাঁ করছে। ভীষণ শূন্যতা তার। গেলে ফুফু খুশি হবেন। আপনাকে যথেষ্ট আদবর আপ্যায়ন করবেন। জকিগঞ্জের গাঁয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলছি। দেখি কত সুন্দর সুন্দও একতলা বাড়ি, দোতলা বাড়ি। ঢিলার ওপরও কত না রঙবেরঙের অট্টালিকা।
মেহেবুব বলল, জানেন, এসব বাড়িতে বাড়িওয়ালা তো নয়ই, তার ছেলেমেয়েরাও থাকে না। কেউ আছে লন্ডন, কেফবা দুবাই, আমেরিকা। দেখাশোনার জন্য কোথাও কেয়ারটেশার নয়তো তালামারা রয়েছে বাড়িঘরগুলো। যেদিকে চোখ যায় দু’চোখ যেন খুঁজে পায়-
মহুল ফুলে জমেছে মৌ
হিজল ডালে ডাহুক ডাকে
ঝিকিমিকি ঝাউয়ের ফাঁকে
বাদামি রোদ ঝলক
দোপাটিতে খোঁপাটি সাজাও’ ……..
গানের এই কথারই প্রতিচ্ছবি। হঠাৎ দেখি পরপর কয়েকটি কামিনী ফুল গাছ-ফুলের শুভ্র ঘ্রাণে মন যেন উতলা হয়ে উঠল। ভাবলাম, বেড়াতে এসে সমুদ্র দেখছি না, ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তিও নেই এখানে, তাতেই-বা কী! বাংলার নয়নলোভা সৌন্দর্য তো মিলেছে এই জকিগঞ্জে—এটা বড় দেখা নয় কি!
মেহেবুব বলল, জানেন, আমার একটা ড্যান্স দল আছে, নাম ‘মেহেবুব ড্যান্স গ্রুপ’। আমি ও আমার দলের ছেলেরা ব্রেক ড্যান্স করি। আপনার কি ভালো লাগে না ব্রেক ড্যান্স ? বললাম, কেন নয়! একটু হেসে মেহেবুব বলল, হিন্দি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করি আমরা। সিলেটে কোনো ফাংশন হলে সেখানেও আমাদের ডাক পড়ে। ‘তুমি তো বেশ মজার মানুষ!’ হাসল মেহেবুব। বয়স সতেরো চলছে, দোয়া করবেন, বড় নৃত্যশিল্পী যেন হতে পারি! ঊাবা তো থাকেন লন্ডনে, আমাকে লন্ডনে নিয়ে যেতে চান। আমার ইচ্ছে নেই!
হঠাৎ দেখি এক গাছের ডালে বসে আছে একটি ছেলে। তার দিকে তাকাতেই একটু হেসে গান ধরল :
পলাশ বনতল উড়েছে কেন আজ
পুলকে ঝলমল রাঙা ফুল সাজ
ওগো মিতা জান কি তা
দখিনা সমীরণ কেন যে বয়ে যায়
আবেশে তনুমন বিত্তবল হয়ে যায়
ভ্রমর গুঞ্জন কি কথা কয়ে যায়…।’
গানটা শেষ হতেই একটু এগিয়ে-এই যে ছেলে তোমার নাম কী ?—‘স্বপন চৌধুরী’। ওই যে ছেলেটা আপনার সঙ্গে দেখছি ও কিন্তু ব্রেক ড্যান্সার আর আমি হলাম ক্লাসিক্যাল ড্যান্সার। তা যাবেন নাকি করিমগঞ্জে—নিয়ে যাব। ও পারবে না, আমি পারব…। দালালদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। মেহেবুব একটু উত্তেজিত হয়ে—তুই জানিস না ফেলানীর কী হয়েছিল ? বাদ দে বাদ দে, অবৈধভাবে উনি কেনইবা যাবেন সীমান্তের ওপারে ওই করিমগঞ্জে। জকিগঞ্জের সৌন্দর্য কি আর কম! স্বপন চৌধুরী এবার বলল, বাড়িতে আসবেন কিন্তু। নাচ দেখাব! ক্লাসিক নাচের মজাটাই ভিন্ন। ওই যে টেলিভিশনে সোহেল আর শিবলি নাচে, ওদের মতোই কিন্তু আমি নাচতে জানি। ওর কথাগুলো মনে বেশ দাগ কাটল। মনে মনে হাসলাম।
সন্ধ্যা হতেই মেহেবুবের সঙ্গে চললাম ওর ফুফুর বাড়ির দিকে। মিনিট পনেরো পর এলাম বাড়ির সামনে। দোতলা বিল্ডিং, সামনে কদম গাছ। অপরদিকে শেফালি, বকুল জুঁই গাছও রয়েছে। কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। মেহেবুবকে কাছে পেয়ে তার ফুফু বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মেহেবুব বলল, ফুফু এই যে একজন ট্যুরিস্টকে নিয়ে এলাম। খুব ভালো লাগবে উনাকে।
ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে আমার। ছেলেপুলে ওরা সবাই লন্ডনে। বছর তিনেক পর ওরা আসে, আবার কখনও আসতেও পারে না। মরে গেলে ওরা আমাকে শেষ দেখাও দেখতে পাবে না। কথাগুলো শুনে ব্যথিত মনে জিজ্ঞেস করলাম, নিকটাত্মীয় কেউ কি আপনার এখানে নেই ? আনমনা হয়ে–আছে! থেকেও যেন নেই, কেউই এখানে আসে না। দুই বোনের একজন করিমগঞ্জে, অপরজন শিলচরে রয়ে গেছে–ওই দুই জায়গা তো ভারতে। যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা কত কী প্রয়োজন! কুশিয়ারা নদী তো দেখছেন, এর ওপারে করিমগঞ্জ। যা ১৯৪৭ সালে ভারতের আসাম রাজ্যের অংশ পড়েছে। অথচ ওই করিমগঞ্জ একসময় ছিল সিলেটের অভ্যন্তরে। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বসে আছি।
দেখতে ছিলাম নায়িকা সুরাইয়ার মতো।
আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম ? একটু হেসে–‘সুরাইয়া চৌধুরী’। দুলাভাইরা বলতেন, আমি নাকি দেখতে অবিকল চিত্রনায়িকা সুরাইয়ার মতোই। তাদের সঙ্গে একবার সিলেটের ‘দিলশাদ’ ছবিঘরে গিয়ে মেলোডি কুইন সুরাইয়া অভিনীত ‘আনমোল ঘড়ি’ ছবিটা দেখে ছিলাম। সেই স্মৃতি আজও যে ভুলিনি, বলুন কী করে ভুলি। কত বছর আগের কথা। আজ যে আমি মুটিয়ে গিয়েছি, বৃদ্ধা হয়েছি। বড় বোনের বাড়ি শিলচরে, বার তিনেক ওখানে গিয়েছি। বরাক নদীর তীরে শিলচর বাঙালি প্রধান শহর। আসামের কাছাড় জেলার সদও দফতর বসেছে ওখানে। শিলচর দেখার পরে দুলাভাই ও বোনের সঙ্গে একবার ডিব্রুগড়ে গিয়েছিলাম। আসামের বাণিজ্যিক শহর-আহা, যা কিনা চা-বাগিচায় ঘেরা। ডিব্রুগড়ও বাঙালি অধ্যুষিত শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ। সেখানেই একবার পরিচয় হয়েছিল সিলেটের ইনাম আহমেদের সঙ্গে। তখনও তিনি অভিনেতা হননি। ওখানে একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সে তো ৭০ বছর আগেকার কথা! সেদিন তো আর ফিরবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে অনুশোচনা থেকে যাবে।
আরও পড়ুন: লন্ডনে যাহা চাও তাহা পাবে হেথা যাও –
বৃদ্ধা রমণীর অতীত দিনের কথাগুরো শুনে একসময় ভাবলাম, মানুষের জীবনটা কী ? তার সবাই আছে, অথচ কেউ পাশে নেই-দূরে, বহুদূরে চলে গেছে। পরদিন বিকালে মেহেবুব, তার ফুফু সুরাইয়া চৌধুরী ও আমি এলাম কুশিয়ারার তীরে। একূল-ওকূল দেখছি।
হঠাৎ দেখি সুরাইয়া চৌধুরী একটু আনমনা হয়ে গানের ভাষায় জানালেন–
তুমি আকাশের পারে আছো
আমি মাটির কাছাকাছি
কত ফুল গেছে ঝরে
তবুও আমি জেগেই আছি।’ ……..
এই গানটা শৈশবে রেকর্ডে শুনেছিলাম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। এই কুশিয়ারার পাড়ে এসে আবারও যে মনে পড়ল সেই স্মৃতি…!
-লিয়াকত হোসেন খোকন