ঢাকার যেসব অনন্য সাধারণ স্থাপত্য কীর্তি ভ্রমণ পিয়াসীদের পদচারণায় মুখরিত

ঢাকা। মোগল আমলে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী। সব ঋতুতে ভ্রমণের জন্য ঢাকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ আর বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রবিন্দুগুলো নিয়ে আলোকপাত করেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন।

মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁন-এর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী ঢাকা কয়েকশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ও স্মৃতি বহন করে আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী। বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বের কারণে দেশের কেন্দ্রস্থল ঢাকা পরিণত হয়েছে কর্মচঞ্চল ব্যস্ত মহানগরীতে। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবান শাহ’র পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দিন বাংলার শাসনভার গ্রহণ করার পরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হলে রাজধানীর জন্য উপযোগী জায়গা খুঁজতে খুঁজতে ঢাকায় এসে পৌঁছেন। কথিত আছে, ইসলাম খাঁ তাঁর অনুচরদের ঢাক বাজানোর হুকুম দিলেন। ঢাকের আওয়াজ যতদূর পর্যন্ত যায় ততদূর পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ করতে নির্দেশ দেন। সুবাদার ইসলাম খানের দ্বারা এভাবে তৎকালীন ঢাকার গোড়াপত্তন শুরু হয়। ঢাক বাজিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয় বলে স্থানটির নাম হয় ‘ঢাকা’। তখন হতেই এই স্থান ‘ঢাকা’ নামে অভিহিত হতে থাকে। ১৬১০ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী সোনারগাঁও হতে স্থানান্তরিত করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

ঢাকার নামকরা মসজিদ ‘তারা মসজিদ’। এই মসজিদের সাদা গায়ে চাকচিক্যময় শত শত ছোট-বড় তারার অলংকরণ। সাদা সিমেন্টের ওপর চীনামাটির তারকাকৃতি টুকরো বসিয়ে করা হয়েছে এই তারকাসজ্জা। ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর অষ্টাদশ শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তখন এর নাম ছিল ‘সিতারা মসজিদ’। পরে এ নাম পাল্টে হয় ‘তারা মসজিদ’। মোহাম্মদপুরের সাতগম্বুজবিশিষ্ট সাত মসজিদ আর বায়তুল মোকাররম মসজিদ দুটিও দেখে নিন। বায়তুল মোকাররম পবিত্র কাবা শরিফের আদলে তৈরি।

বাহাদুর শাহ পার্কও দেখতে পারেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় যাঁরা শহিদ হন তাঁদের স্মৃতিরক্ষার্থে বাহাদুর শাহ পার্ক নির্মিত হয়। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে সৈনিকরা পরাজিত হলে তাদের সবাইকে বন্দী করা হয়। এরপর ওই সৈনিকদের ফাঁসির ব্যবস্থা করে বিট্রিশ সরকার। সেই গণহত্যার জায়গায় তৈরি হয়েছে বাহাদুর শাহ পার্ক।

আরও পড়ুন: লন্ডনে যাহা চাও তাহা পাবে হেথা যাও

লর্ড কার্জন নির্মাণ করেছিলেন ‘কার্জন হল’। এটি ঘুরে দেখুন। একদা এটি ছিল ব্রিটিশ গভর্নরের বাসগৃহ। কার্জন হল ঢাকার অন্যতম আকর্ষণ। ঢাকার নিমতলিতে এর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করা হয় ১৯০৪ সালে। ঢাকা কলেজের অবস্থান ছিল একসময়ে কার্জন হলে। ১৯০৮ সালের জুন মাসে ঢাকা কলেজ স্থানান্তর হয় কার্জন হলে। ১৯২১ সাল থেকে কার্জন হলকে ব্যবহার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের অংশ হিসেবে। কার্জন হলের ভবনটি দ্বিতল। এই ভবনের চারপার্শ্বে রয়েছে প্রশস্ত বাগান। ভিতরে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির কেন্দ্রীয় হল। ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত এই ভবনটিতে সংযোজিত আছে ইউরোপ ও মোগল স্থাপত্যরীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ, যা দেখে বারবার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। শাহবাগ এলাকার দক্ষিণে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পাশে দোয়েল-চত্বরের কাছে তিন নেতার সমাধি। এই নেতা হলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমউদ্দিন।

ঢাকার শেরে বাংলা নগরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। দূর থেকে দেখলে এটিকে মনে হয় সাদা রঙের কোনো প্রাচীন ইউরোপীয় দুর্গ। এই সংসদ ভবনের নকশা বানিয়েছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি লুই আইন কান।

মিরপুরে চিড়িয়াখানা ও ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন পাশাপাশি। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে চিড়িয়াখানা অবস্থিত। এর আয়তন ২৩০ একর জায়গা নিয়ে। ১২৪টি বিরল জাতের প্রাণীসহ মোট ১,৪০০ রকম পশুপাখি ও জন্তু জানোয়ার রয়েছে এই বিশাল চিড়িয়াখানায়। ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে ১০০ রকমের গোলাপ গাছ, ১১ হাজার রকমের বৃক্ষ, নানা সুগন্ধি গাছ, একটি বিশাল পুরনো বটবৃক্ষও আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় –

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল কম্পাউডে রয়েছে কলাভবন, বিজ্ঞানভবন, কার্জন হল, সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, সূর্যসেন হল, মোহসীন হল, রোকেয়া হল, সামসুন নাহার হল, বাংলা একাডেমি, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, মসজিদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি, শহীদুল্লাহ্ হলের পাশে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সমাধি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় জাদুঘর, টিএসসি সড়ক দ্বীপে ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ১৯১১ সালে ঢাকার কার্জন হলে বড়লাট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির শুভাগমন উপলক্ষে সংবর্ধনাসভায় পৃথক দুটি মানপত্রে নওয়াব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি ক্লাস শুরু হয়।

ঢাকেশ্বরী মন্দির –

 এই মন্দিরের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করে প্রশস্ত প্রাঙ্গণের ধারে পরপর ৪টি মাঝারি মাপের শিবমন্দির দেখবেন। ডানদিকের দরজা পেরিয়ে আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোট চৌহদ্দি। তার মধ্যে ঢাকেশ্বরী দুর্গামন্দির এবং সামনে নাটমন্দির। নিত্য পূজা হয়। কিংবদন্তি আছে, বল্লাল সেন স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিলেন এইখানে জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছেন এক দেবী। তিনি দেবীকে আবিষ্কার করে মন্দির নির্মাণ করে দেন এবং পূজার ব্যবস্থা করেন। ঢাকা পড়েছিলেন বলে দেবীর নাম হয় ‘ঢাকেশ্বরী’।

‘ঢাকা’ নাম নিয়ে সবচাইতে বেশি চমক সৃষ্টি করেছে ঢাকেশ্বরী মন্দির। গভীর রহস্যের ঘেরাটোপে ঢাকা ঢাকেশ্বরী মন্দির। পাশাপাশি পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি ঢাকা নগরীর একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। ঢাকা নামকরণ আগে, না ঢাকেশ্বরী মন্দির আগে এবং মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। কারো মতে, ঢাকেশ্বরী মন্দির আসলে একটি আরাকানি বৌদ্ধ কৃষ্টির মন্দির। মন্দির নির্মাণ স্থাপত্য বিন্যাসে মোগল স্থাপত্যকলার অনুশীলন বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। মন্দিরটি নির্মাণ স্থাপত্যে চুন ও কালির মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে। মÊপ, পুকুর, বটবৃক্ষ, পান্থশালা, সন্ন্যাসীদের ঘর এবং মন্দিরের গঠনকাঠামো দেখে ধারণা করা হয় এটি আরাকানি বৌদ্ধমন্দির, যা পরবর্তীতে হিন্দুদের দখলে চলে যায়। ব্রাডলি বার্ট তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘প্রাচ্যের রহস্য নগরী’তে দাবি করেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন হিন্দু এজেন্ট ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজা বল্লাল সেন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এখানে এসে বনজঙ্গলাকীর্ণ মাটির তলায় ঢাকা দশ ভরি সোনা, রূপা, তামা, কাঁসা, পিতল, লোহা, দস্তা ও সিসা অষ্টধাতুর তৈরি একটি মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপন করেন। ঢাকা যোগে ঈশ্বরী ঢাকেশ্বরী এর নাম। যেমন পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর আছে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির। তবে এক এক জায়গায় ঈশ্বরের এক এক নাম। ত্রিপুরেশ্বরীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিশাল আকৃতির চার হাতের কালীদেবী। ঢাকেশ্বরী দশ হাতের দুর্গাদেবী। সারাবছর ধরেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে কম-বেশি ভিড় হয়। দুর্গাপূজার সময় ভিড়ের চাপে এ মন্দির এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সাধারণ হিন্দু ভক্তরা এখানে এসে রাজা বল্লাল সেনের স্বপ্নে পাওয়া ঢাকার ঈশ্বরীকে জাগ্রত দেবীরূপে পূজা মানত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা অষ্টধাতুর আসল ঢাকেশ্বরী মূর্তিটি চুরি করে নিয়ে যায়।

শহিদ মিনার : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশেই ভাষা-আন্দোলনের শহিদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত শহিদ মিনার। প্রশস্ত উঁচু বেদির ওপর এই শহিদ মিনার। এটি ১৯৫২ সালের রক্তে রাঙা ২১শে ফেব্রæয়ারিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন মনে পড়বে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের নাম। যে স্থানে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ হয়েছিল সেখানে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাতের অন্ধকারে চাত্র-জনতা নিজেদের নকশা অনুযায়ী ইট দিয়ে প্রথম শহিদ মিনার স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এটি ভেঙে দেয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ২১ ফেব্রূয়ারি ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবু হোসেন সরকার ও শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম যৌথভাবে শহিদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে বিশাল আকারে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্পী হামিদুর রহমান এর নকশা করে দেন। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি –

ধানমন্ডি এলাকার ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডির এ বাড়ি না দেখলে ঢাকা-দর্শন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই বাড়িতে বাস করে গেছেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রাণপুরুষ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এইখানেই ঘাতকের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ধরণীর কোলে লুটিয়ে পড়েছেন তিনি।

বলধা গার্ডেন –

বলধা গার্ডেন তৈরি হয় ১৯০৯ সালে। নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী এই বাগানবাড়িটি কিনে নেন পূর্ববর্তী জমিদারের কাছ থেকে। ১৯৩৬ সাল থেকে এই বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা লাগানো শুরু হয়। ১৯৪০ সালের মধ্যে এই গার্ডেনে ফুলগাছসহ অন্যান্য গাছে ভরপুর হয়ে ওঠে। অনেকের মতে, সূর্যঘড়িটি গত শতাব্দীর প্রথমদিকে তৈরি করা হয়েছিল। এটি এবং একটি পুকুরসহ বাগানবাড়িটি ক্রয় করেন জমিদার নরেন্দ্রনারায়ন রায় চৌধুরী।

সূর্যঘড়ির আশেপাশে অগ্নিশর ও লিলি গাছ রয়েছে, এর পূর্বপার্শ্বে গ্রিনহাউজ। এখানে ছায়াজাতীয় গাছ, যেমন অর্কিড, অ্যানথোরিয়ান, ডাইরেন কোটিয়া প্রভৃতি আছে। বলধা গার্ডেনে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু দর্শনার্থী এসে সূর্যঘড়িটি দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। আমেরিকান, ব্রিটিশ অনেক দর্শনার্থী এই ঘড়িটি দেখে উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করে গেছেন। সৌদি আরবের এক মেজর এই ঘড়ি দেখে মন্তব্য করে বলেছেন : “বলধা গার্ডেনের যা কিছু সৌন্দর্য, যা কিছু আকর্ষণ সবই এসে ঠেকেছে সূর্যঘড়িটির গায়ে। বড়ই আকর্ষণ এর। আমরা যে ঘড়ি হাতে দেই তা মাঝে মাঝে ফাঁকি দেয়। এর কোনো প্রাণ নেই। তবে সূর্যঘড়িটির প্রাণ আছে।”

জানা যায়, বলধা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগির পরে ঘড়িসহ গাছগাছালির সৌন্দর্য কমতে থাকে। ১৯৬২ সালে বলধা গার্ডেন বন বিভাগের আওতায় নেওয়া হয় এবং পূর্বের জৌলুশ আবারও ফিরিয়ে আনা হয়। পাকিস্তান আমলে গার্ডেনে প্রবেশ ফি ছিল যথাক্রমে ২৫ পয়সা ও ৫০ পয়সা। মাঝখানে অনেকদিন প্রবেশ ফি ছিল না। ১৯৮৬ সাল থেকে আবার প্রবেশমূল্য চালু করা হয়। বর্তমানে এই গার্ডেনে শতাধিক জাতের ফুল ও অন্যান্য গাছ রয়েছে।

লালবাগ দুর্গ –

লালবাগ দুর্গ

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মোহাম্মদ আযমের সময়ে লালবাগের স্থাপত্যশিল্প নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরীবিবির সমাধি, দরবারগৃহ, হাম্মামখানা, মসজিদ, দুর্গ, গেট ইত্যাদি এখনও আকর্ষণীয়। সংরক্ষিত এলাকা ঘোষিত হওয়ার পরে স্থাপিত হয়েছে উদ্যান ও ঝরনা।

গেট থেকে প্রবেশ করেই দেখবেন উদ্যানে নানা রঙের ফুল ফুটেছে। ফোয়ারা, পানির লন, পশ্চিমে মসজিদ, এরই একটু পূর্বে মাঝখানে পরীবিবির সমাধিসৌধ। পরীবিবি ছিলেন শায়েস্তা খানের আদরের মেয়ে। শায়েস্তা খান দুর্গ নির্মাণের কাজ শেষ করার জন্য যখনই প্রস্তুতি নিলেন তখন তাঁর অতি আদরের কন্যা পরীবিবি মারা গেলেন। এজন্য শায়েস্তা খান দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। পরীবিবিকে দুর্গ-অভ্যন্তরে সমাহিত করে একটি মনোরম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং তাই করলেন। পরীবিবির সমাধিসৌধটি দেখে আপনিও অভিভূত হবেন। এটি তাজমহল ও হুমায়ুনের সমাধিসৌধের প্লানে নির্মিত হয়েছে। এই সমাধিসৌধের দেয়ালে দেখবেন গ্লেস টাইলস, আবার ইটের ওপর মিনার করা হয়েছে। ভেতরের দেয়ালে সাদা ও কালো পাথর লাগানো রয়েছে। সাদা পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে আর কালো পাথর আনা হয় জয়পুর থেকে। পরীবিবির সমাধির মাঝখানের রুমের দরজাটি চন্দন কাঠ দিয়ে তৈরি। পূর্বদিকের রুমে তার বোন শামসাদ বেগমের কবর দেখবেন। সমাধিসৌধের উপরে বাইরের দিকে একটি গম্বুজ দেখতে পাবেন।

লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরের দিঘিটি আকর্ষণীয়। ১৮৫৭-তে সিপাহি বিদ্রোহের সময় নিহত অনেক সৈনিককে এই দিঘিতে ফেলা হয়। তারপর অনেক বছর যাবৎ এই দিঘির পাশে দুপুরে ও সন্ধ্যার পরে লোকজন আসতে ভয় পেত। একসময় লালবাগ দুর্গ জঙ্গলে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পরে জঙ্গল পরিষ্কার করে লালবার্গ দুর্গকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। পরীবিবির সমাধিসৌধের দক্ষিণে মাটির ঢিবির উপরে উঠে দুর্গ দেখে নিন। সৈনিকরা যেখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিত সেখানে আপনি কিছু সময় দাঁড়িয়ে মোগল আমলের কথা স্মরণ করতে পারেন। বেশ ভালোই লাগবে। তখন মোগলদের ঐতিহ্যের কথা জানতে আপনার মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন: রহস্যে ঘেরা কামরূপ কামাক্ষ্যা

১৬৭৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র আযম শাহকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। তিনি স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণে উৎসাহী ছিলেন। তিনিই ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সেনানিবাস ও রাজপ্রাসাদ সমš^য়ে লালবাগ দুর্গ নির্মাণ শুরু করেন। পিতার নামানুষারে এই দুর্গের নাম দিলেন ‘আওরঙ্গবাদ দুর্গ’। দুর্গ নির্মাণের কাজ শেষ না হতেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। এরপর সুবাদার হয়ে এলেন শায়েস্তা খান। তিনিই দুর্গের আরও কিছু কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।

দরবারগৃহটি এখন জাদুঘর। ঢিলার পাশে একটি গুহা আছে ওখানে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হতো। জাদুঘরে প্রবেশ করেই নিচতলায় দেখবেন মোগলদের বর্শামূল, বল্লম ফলক, ঢাল, তরবারি, ফ্রিন্টলক, বন্দুক ও রাইফেল। মোগল সৈন্যের প্রতিকৃতিও দেখবেন। আরও দেখবেন ১৮শ-১৯শ শতকের চীনা পাত্র, তীর, ধনুক, ফুল, মালা, অলংকৃত পাথর, হাতকুঠার, ফ্রিন্টলক, পিস্তল, কামানের গুলি। দোতলায় দেখবেন হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের আমলের মুদ্রা, পাথরের শিলালিপি, পারস্যের তৈরি বাসনপত্র, কার্পেট, আরবি ও ফারসি ভাষায় হাতে লেখা বিভিন্ন কেতাব। এছাড়াও আছে উল্লেখযোগ্য চিত্রকলা। আরও দেখবেন সম্রাট আকবরের ফরমান ও শাহ আমলের পরওয়ানা।

আহসান মঞ্জিল –

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জালালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে ‘রংমহল’ নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র রংমহলটি এক ফরাসি বণিকের নিকট বিক্রি করে দেন। বাণিজ্যকুঠি হিসেবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিতি ছিল। এরপরে ১৮৩৫-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গনির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। নওয়াব আবদুল গনি ১৮৭২ সালে প্রাসাদটি নতুন করে নির্মাণ করান। নতুন ভবন নির্মাণের পরে তিনি তাঁর পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামানুষারে এর নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এই ভবনটি ভেঙে পড়ায় তা পুনঃনির্মাণ করা হয়। আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। এর গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় ‘রংমহল’। পশ্চিম দিকের আবাসিক প্রকোষ্ঠাদি দিয়ে গঠিত ভবনকে ‘অন্দরমহল’ বলা হয়।

হোসেনী দালান নির্মাণ করেন কে ?-

হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণে নির্মিত অপরূপ স্মৃতিসৌধ হোসেনী দালান ১৬৪২ সালে নির্মিত হয় ঢাকার নিমতলীর কাছে। এটি দেখে কারবালার সেই করুণ কাহিনী মনে করতে পারবেন হয়তোবা।

১৬৪২ সালে শাহ সুজার নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ এই ইমারত তৈরি করেছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন হযরত ইমাম হোসেন ও ইমাম হাসান (রা.) কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করছেন। এমনকি সেদিন রাতে তিনি স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন তিনিও যেন কারবালার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। সে কারণেই শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ সেনাপতি মুরাদ ইমামবাড়া, হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। এসব ঘটনা শুনে আপনি অতীত যুগে ফিরে যাবেন। তাজিয়া দেখে দারুণ মুগ্ধ হবেন। আরও জানবেন, ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে দালানটির অধিকাংশ ভেঙে যায়। এরপর ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ ১ লাখ টাকা ব্যয় করে ভনটি আরও সুন্দরভাবে নির্মাণ করিয়ে দেন।

সকাল-সন্ধ্যা-বিকেল যখনই যাবেন, দেখবেন কবরের প্রতিকৃতি দুটিতে অনেকেই ফুল-মালা, টাকা-পয়সা, গোলাপজল ও আতর দিয়ে যাচ্ছে। এবার দক্ষিণ ও উত্তর দিকের বারান্দায় গিয়ে কারবালার যুদ্ধের দুটি বিরাটাকৃতির তৈলচিত্র দেখে নিন।

ঢাকা সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য –

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। ঢাকা নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক জনশ্রæতি রয়েছে। কেউ বলেছেন বল্লাল সেন কর্তৃক নির্মিত ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে ‘ঢাকা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। কেউ বলেছেন ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁ বুড়িগঙ্গার কাছে ‘ঢাক’ বাজিয়ে যতদূর শোনা যায়, ততদূর পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ করে সে এলাকায় রাজধানী বানান। সেই এলাকাই ‘ঢাকা’ নামে পরিচিত। ঢাকা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বংশী ও ধলেশ্বরী নদী। ঢাকা জেলায় উপজেলা রয়েছে ৫টি : সাভার, ধামরাই, দোহার, নবাবগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ। ঢাকার উল্লেখযোগ্য জায়গা হলো : সূত্রাপুর, মতিঝিল, ডেমরা, রমনা, লালবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, পল্লবী, সবুজবাগ, উত্তরা, কামরাঙ্গিরচর। ঢাকা জেলার আয়তন ১,৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার। ঢাকার কৃতী সন্তান হলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব আহসানউল্লাহ, খাজা আবদুল গনি, কবি কায়কোবাদ, মাজেদ সর্দার প্রমুখ।

ঢাকা জেলার স্থাপত্য নিদর্শন হলো : জয়কালী মন্দির, কার্জন হল, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথ, রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ি, রোয়াইল জমিদারবাড়ি, গাংগুটিয়া জমিদারবাড়ি, সোয়াপুর জমিদারবাড়ি, নবাবগঞ্জের যোগমায়া মঠ, ধামরাইয়ের বৌদ্ধবিহারসহ অনেক প্রাচীন দর্শনীয় স্থান।

ঢাকার মসজিদ –

ঢাকা শহরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সাথে মসজিদ স্থাপত্যশিল্পেরও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলো মোগল আমলেই (১৩৩৮-১৫৩৮) সূত্রপাত ঘটে। কালের বিবর্তনে ঢাকার চারশো বছরে মসজিদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় মসজিদ ‘বায়তুল মোকারকম’ ১৯৬২ সালে স্থাপিত। সাততলা-বিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি নামাজি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন।

সুলতান মাহমুদ শাহ-এর শাসনকালে ১৪৫৪ সালে মারহামাতের কন্যা বখত্ বিনাত কর্তৃক স্থাপিত ‘বিনাত বিবির মসজিদ’ বাংলার অন্যতম প্রথম মসজিদ। এটি ঢাকার নারিন্দা এলাকায় অবস্থিত এক গম্বুজবিশিষ্ট ১২ বর্গফুট বিশিষ্ট সুদৃশ্য মসজিদ। ‘সাত মসজিদ’ বা সাতগম্বুজবিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি ১৮৭৪ সালে মোহাম্মদপুর এলাকায় স্থাপিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ভিতরে অবস্থিত ‘মুসা খাঁ’র মসজিদ সম্ভবত ঈশা খাঁ অথবা তাঁর ছেলে মুসা খাঁ তৈরি করেন।

সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরে মসজিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজারেও বেশি। এর মধ্যে মিরপুর এলাকায় ৯০টি; পীরেরবাগ, কল্যাণপুর পাইকপাড়া, আমিনবাজার, গাবতলী, বেগুনবাড়ি, দেওয়ানবাড়ি ও আশপাশ এলাকায় ১৪২টি; মিরপুর ১১, ১২, পল্লবি, কালশী এলাকায় ৬৩টি মিরপুর ৬, ৭, ১০, ১৩, ১৪, ১৭ ও কাজীপাড়া, ধানমন্ডি, কলাবাগান, গ্রীনরোড, জিগাতলা, শংকর, রায়েরবাজার, শুক্রাবাদ ও আশপাশ এলাকায় ৭৩টি; আজিমপুর, পলাশী, নিউমার্কেট ও পরিবাগ এলাকায় ৪৬টি; বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৩৩টি।

হাইকোর্ট মাজার

হাইকোর্ট মাজার নামে পরিচিত বিখ্যাত ওলি হযরত খাজা শরফ উদ্দিন চিশতি (র.)-এর মাজারটি পুরনো হাইকোর্ট ভবনের সামান্য পূর্বদিকে অবস্থিত। এটি ‘চিশতি বিহিস্তীর মাজার’ নামে পরিচিত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, চিশতি বিহিস্তী মাজারটি মূলত ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা সুবেদার ইসলাম খান চিশতির সমাদিসৌধ ছিল।

আবার অনেকে মনে করেন কামেল ওলি হযরত খাজা শরফ উদ্দিন চিশতি (র.) আজমির শরিফ থেকে এখানে এসে অবস্থান করেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। তাঁর সমাধিস্থলই হাইকোর্ট মাজার।

আগে মাজারটির ইমারত সাদাসিধে ছিল। একখÊ উঁচু জমির ওপর ছিল বর্গার ছোট মাজার। পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের ফলে মাজারটি বর্তমান অবস্থায় এসেছে। প্রতিদিন এ মাজারে দর্শনার্থী আসে। তবে বৃহস্পতিবার মাজার প্রাঙ্গণে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়। দেশের বিভিন্ন মাজারে অনুষ্ঠিত ওরশের গানের শিল্পীদের খোঁজেও অনেকে আসেন হাইকোর্ট মাজারের গেইটের সামনে গাছতলে।

শাহ আলী বোগদাদীর মাজার

কথিত আছে, প্রায় চারশো বছর আগে শাহ আলী নামে বাগদাদের এক রাজপুত্র সংসারের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে চারজন শিষ্যসহ নানা দেশ ঘুরে ঘুরে ঢাকা মিরপুরের ছোট্ট একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মসজিদের দ্বার রুদ্ধ করে ধ্যানমগ্ন থাকেন। নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হওয়ার একদিন আগে শিষ্যরা অস্পষ্ট শব্দ শুনে মসজিদের দ্বার খুলে দেখেন শাহ আলী সেখানে নেই। একটি গর্তে রক্ত-মাংস পড়ে আছে। শিষ্যরা শাহ আলীর কণ্ঠে দৈব নির্দেশ পেল পাত্রের রক্ত-মাংস সমাধিস্থ করার। হযরত শাহ আলীর সে সমাধিস্থলই মিরপুরের শাহ আলীর দরগা নামে পরিচিত।

 ঢাকার নবাব স্যার আব্দুল গণি সেখানে একটি মসজিদ ও দরগার কাছে একটি পুষ্পোদ্যান তৈরি ও ছোট্ট পুকুর খনন করে দেন। দরগায় আসার দুটি রাস্তাও তৈরি করে দেন। দরগার বার্ষিক উৎসব উদ্যাপন ও সমাধিস্থল দেখার জন্য শত শত মানুষ আসে মিরপুরের শাহ আলীর দরগায়।

মালিক পীর ইয়েমেনির মাজার

গুলিস্তান এলাকার জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ওসমানী উদ্যানের উপর-পূর্ব কোণে মালিক পীর ইয়েমেনির মাজারটি অবস্থিত। ধারণা করা হয় যে, তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে ইয়েমেন থেকে এদেশে আসেন। ১৪শ শতকে এখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯শ শতকে ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর কবরের ওপরে বর্তমান সমাধিসৌধটি নির্মিত হয়।

গোলাপ শাহ মাজার

ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে গুলিস্তানের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে গোলাপ শাহ মাজার। মূল সড়কের একেবারে মধ্যখানে অবস্থিত এ মাজার ভক্তদের কাছে খুব আকর্ষণীয়।

পীরজঙ্গীর মাজার

মতিঝিল কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছেই অবস্থিত পীরজঙ্গীর মাজার। নামের উৎস সম্পর্কে এ মাজারের রয়েছে নানা কিংবদন্তি।

ঢাকায় তিন নেতার মাজার –

ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী ইদ্যানের (পূর্বে রেসকোর্স ময়দান) দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঐতিহাসিক হাজী শাহবাজ মসজিদের কাছে জাতীয় তিন নেতার সমাধিসৌধ অবস্থিত। পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সাবেক পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন – এ তিন নেতা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এ মাজারে। তিনটি উঁচু কলম দ্বারা নির্মিত এ সমাধিসৌধের ভিতরে প্রবেশের জন্য তিনটি সুড়ঙ্গের মতো পথ রয়েছে। সামনে ফাঁকা জায়গায় ফুলের বাগান। এ চমৎকার দৃষ্টিনন্দন সমাধিসৌধের স্থপতি মাসুদ আহমেদ।

শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার (ব্রিটিশ আমলে) মুখ্যমন্ত্রী, পুর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর-প্রস্তাবের রচয়িতা ও বাঙালিদের দাবিদাওয়া, বিশেষ করে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথমে আইনমন্ত্রী, পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের পূর্বে একটি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন দেশের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। পাকিস্তানিদের দ্বারা তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন। ফলে বাঙালিদের কাছে তিনি প্রিয় হয়ে ওঠেন।

খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের সন্তান। কিন্তু তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। ফলে তাঁর বেশি সখ্যতা ছিল পাকিস্তানিদের সাথে। পাকিস্তানিদের মাতৃভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ১৯৪৮ সালে তিনি যে আহবান জানান, পূর্ববাংলার (বাংলাদেশ) ছাত্র-জনতা তা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করে। এর প্রেক্ষিতেই ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলায় ভাষা-আন্দোলন গড়ে ওঠে।

মোহাম্মদপুরের সাতগম্বুজ মসজিদ –

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ সাতগম্বুজ মসজিদটি নির্মাণ করান। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনের ধারাবাহিকতায় যে স্থাপত্যরীতি প্রচলিত রয়েছে, তারই উদাহরণ সাতগম্বুজ মসজিদটি। এক তথ্যে জানা যায়, নবাব শায়েস্তা খাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ এর প্রতিষ্ঠাতা। এর ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোণায় একটি করে ছোট গম্বুজ থাকায় একে সাতগম্বুজ মসজিদ বলা হয়। এর আয়তাকার নামাজ কোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। এর পূর্বদিকের গায়ে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মসজিদের পূর্বপাশে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশে রয়েছে একটি সমাধি। কথিত আছে, এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’ বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোণাকৃতি এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোণাকৃতির। এখানে মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যানও রয়েছে। একসময় মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। কিন্তু বর্তমান এ অবস্থা আর নেই।

রমনা কালীবাড়ি –

ঢাকার এ কালীবাড়িটির রয়েছে কয়েক শত বছরের ইতিহাস। মহানগরীর প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এ বাড়ি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রাচীন নিদর্শনটি গুঁড়িয়ে দেয়। নির্মাণের ধারাবাহিকায় একে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। শঙ্করাচার্যের অনুসারী দশনামি গোত্রের মন্দির ছিল এখানে। প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি মতের বিশ্বাসীদের আখড়ায় পরিণত হলেও পরে নির্মাণ হয় মন্দির এবং নাম হয় কৃপাসিদ্ধির আখড়া। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দানীর মতে, প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠ থেকে গোলাপগিরি নামে এক ব্যক্তি ঢাকায় এসে একটি আখড়ার পত্তন করেছিলেন। তখন এটির নাম ছিল কাঠঘর। প্রাচীন মন্দিরটি ঘিরে ছিল একটি দেয়াল এবং একটি দিঘি কাটিয়েছিলেন ভাওয়ালের রানি বিলাসমনি। সম্ভবত তখন ঢাকা ছিল ভাওয়াল এস্টেটের অধীনে। এই কালীবাড়িতে নরবলি হতো এ কথা সবাই বলত। অন্ধকারে এ মন্দিরের পাশ বা দিয়ে দিনের বেলায় চলাচল করতে অনেকে ভয় পেতেন।

খাজা শাহবাজ মসজিদ ও সমাধিসৌধ –

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তিন নেতার মাজারের পেছনে খয়েরি রঙের বেশ পুরনো একটি মসজিদ ও সমাদিসৌধ রয়েছে। মোগল স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে হাজি খাজা শাহবাজ (র.)-এর নামে এক ব্যবসায়ী ৩০০ বছর আগে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। সুবেদার শাহ আজমের সময় (১৬৭৭-৭৮) খাজা শাহবাজ কাশ্মীর থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসায় শুরু করেন। অচিরেই তিনি বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হন। মিতব্যয়ী এ ব্যক্তি থাকতেন টঙ্গী। প্রতিদিন হেঁটে যাওয়া-আসা করতেন। তিনি রমনা এলাকায় একটি চিত্তাকর্ষক মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৭৯ সালে তিনি রমনায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। রমনার পূর্ব দিকে ছিল খাজা শরফুদ্দিন চিশতি (র.) এর মাজার এবং মাঠের মাঝখানে ছিল ৫০০ বছরের পুরনো কালীমন্দির। এমন স্থানে মসজিদটি নির্মিত হওয়ার পরে এ এলাকার সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত নামজ পড়তে। খাজা শাহবাজও টঙ্গী যাওয়া-আসার পথে নামাজ পড়তেন এ মসজিদে। ভূমি থেকে তিন ফুট উঁচুতে নির্মিত এ মসজিদটি প্রায় এক বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। এর দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে নিচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং পশ্চিম ও উত্তর প্রান্তটি লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মসজিদে প্রবেশের জন্য পাঁচটি আকর্ষণীয় দরজা রয়েছে। এর প্রতি কোণে একটি বড় মিনার ও দুটি ছোট মিনার রয়েছে। মসজিদের ২০ গজ দূরে এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধে শায়িত আছেন খাজা শাহবাজ (র.)। মৃত্যুর আগেই তিনি এটি নির্মাণ করান।

আশালতা সেনের বাড়ি এখন মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয় –

পূর্ব বাংলার নারী আন্দোলনের অগ্রগণ্য কর্মী, ব্রিটিশবিরোধী নেত্রী, কবি ও সমাজসেবী আশালতা সেন ১৮৯৪ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের বীরগাঁও গ্রামে।

শৈশবেই সাহিত্যে ঝুঁকে পড়েন তিনি। ঠাকুরমা নবশশী দেবীর উৎসাহে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নবশশী দেবী বিক্রমপুরে নারী সমাজ গড়ে তুলেছিলেন এবং সেখানে বিদেশি কাপড় বর্জনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নাতনি আশার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটান। ঠাকুরমার উৎসাহে তিনি বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী পড়ে নিজের দেশাত্ববোধকে জাগ্রত করেছিল। ১৯১৬ সালে স্বামী সত্যরঞ্জন সেনের মৃত্যুর পর রাজনীতি থেকে তিনি কিছুকাল বিরত ছিলেন। তবে সন্তান বড় হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে পুনরায় যোগ দেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

নারী কল্যাণে তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসায় সেলাই প্রকল্প চালু করেছিলেন। এরই পথ ধরে ১৯২৫ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া ওয়েভার্স সোসাইটির সদস্যা হন। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর গেন্ডারিয়ার মহিলা সমিতি অবৈধ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। এ আন্দোলনের ফলে তাঁকে সাড়ে ৭ মাস জেল খাটতে হয়। ১৯৮৬ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি তিনি দিল্লিতে পরলোকগমন করেন। তাঁর গেন্ডারিয়ার বাড়িটি এখন মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।

নিমতলী গেট

নবাবি ঐতিত্যের আদলে তৈরি করা হয় নিমতলী গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারিয়েট রোড থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির সামনের সড়কে একসময় অবস্থিত ছিল এ গেট। কালের বিবর্তনে এটি হারিয়ে যায়।

Leave a Comment