লন্ডনে যাহা চাও তাহা পাবে হেথা যাও –

লন্ডন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর যুক্তরাজ্যের রাজধানী। বিশ্বের বেশিরভাগ ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে পরম আরাধ্য একটি স্থান এই ঐতিহাসিক নগরী। লন্ডন ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ভ্রমণ বিষয়ক লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

যখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের কথা শুনেছিলাম। বড় ভাইদের মুখে মুখে শুনেছি শেক্সপিয়রের নাম। তাঁর কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস এক সময় খুবই ভালো লাগত। আজ সেসব স্মৃতি।

সম্ভবত সোহরাব মোদি পরিচালিত ‘হ্যামলেট’ ছবিটি দেখে শেক্সপিয়রকে জানার জন্য মনটা বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠল। কিশোর সাহু পরিচালিত ‘হ্যামলেট’ ছবিটিও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। অতীতে লন্ডন আর শেক্সপিয়রকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ ছিল না।

ইংল্যান্ডে অনেকেই যান, কিন্তু শেক্সপিয়রের বাড়ি দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয় না। শেক্সপিয়রের বাড়ি হেনলি ষ্ট্রীটে অবস্থিত। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের জন্ম হেনলি ষ্ট্রীটস্থ পৈত্রিক বাড়িতে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ এপ্রিল। তাঁর বাবা মিস্টার জন ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ী। স্থানীয় গ্রামের স্কুলে শেক্সপিয়র পড়াশোনা করেছিলেন।

বিয়ের পরে শেক্সপিয়র চলে আসেন লন্ডনে। লন্ডনে এসেই নাটক লিখে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। শুধু তাই নয়, যশ -খ্যাতি পেলেন গোটা বিশ্বজুড়ে। শেক্সপিয়র যে বাড়িতে জন্মেছিলেন সেই বাড়িটি আজ আর নেই। সেখানে পরবর্তীতে একটি বিশাল বাড়ি তৈরি করা হয়। তবে এমন কায়দায় ঘরদোর, আসবাবপত্র রাখা হয়েছে, দেখে মনে হবে বুঝি সবকিছুই আগেকার।

উইলিয়াম_সেক্সপিয়র

বাড়িটি দোতলা – এই দোতলা বাড়িটি জাতীয় সম্পত্তি। ব্রিটিশ সরকার এটি ক্রয় করে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। শেক্সপীয়রের বাড়িতে যা কিছু আছে সবই সাজানো -গোছানো, সবই যেন এৰিজাবেথীয় কায়দায়।

বাড়িটির দোতলায় রয়েছে কবি নাট্যকারের স্মৃতি কর্ম। ঘরের মাঝখানে রয়েছে পালঙ্ক। এককোণে ছোট্ট শিশুর জন্যে ছোট একটি দোলনা রয়েছে। সেটি দেখা যায়, কিন্তু দোলনায় দোলা যাবে না।

শেক্সপিয়র সংক্রান্ত কিছু বইপত্র সাজিয়ে রাখা আছে একটি ঘরে। নানা ভাষায় লেখা বই সবই শেক্সপিয়রের ওপর।

একটি কক্ষে আছে ইংল্যান্ডের মধ্যযুগের মধ্যবিত্ত পরিবার ও সমাজের চিরচেনা চেহারা, সুন্দর করে বিছানা সাজানো। বাড়ির রান্নাঘরও দেখবার মতো। তরকারি ও মাংস কাটার যন্ত্রপাতি – এগুলো শেক্সপিয়রের পরিবার ব্যবহার করত।

শেক্সপিয়রের বাড়ির খুব কাছেই হোলি ট্রিনিটি চার্চ। সেখানে মহাকবি শেক্সপিয়রের দেহ সমাধিস্থ রয়েছে । এরপরে অ্যান হ্যাথাওয়ের কুটির। এর ওপরে খড়ের চালা। বাড়ির সামনে বাগান – ফুল আর ফল।

হোলি ট্রিনিটি চার্চে শেক্সপিয়রকে সমাধিস্থ করা হয় ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল।

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে শেক্সপিয়রের বাড়ি ট্রাস্টির হাতে চলে যায়।

শেক্সপিয়রের মা ম্যারি আর্ডেনের বাড়ি উইন্সকোর্টে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এটিও সংরক্ষণ করে।

শেক্সপিয়রের সমাধিগৃহের কাছেই তাঁর মেয়ে সুজানার বাড়ি ছিল – এটিও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

ইংল্যান্ডের অ্যাভন নদীর তীরে রয়েছে শেক্সপিয়র থিয়েটার হল – এটিও চমৎকার। এর নকশাটি এলিজাবেথ স্কটের করা। এটি নতুন করে তৈরি করা হয় ১৯৩২ সালে।

হিথরো বিমানবন্দরে নেমেই যেতে হয় গ্রেটব্রিটেনের বা যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে।

লন্ডনের মতো এত সৌন্দর্য, প্রমোদ, প্রাসাদ, ধন, সঙ্গীত, মনীষা, রাজকীয় আড়ম্বর ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অহংকার ভূ -পৃষ্ঠের অন্য কোনো বিন্দুতে একত্রিত নয়। এজন্যই লন্ডন লন্ডনই।

লন্ডন

টেমস নদীর তীরে লন্ডন – টেমস নদী খুবই আকর্ষণীয়। প্রমোদ তরী ছাড়ে ওয়েস্ট মিন্সটর, চ্যাকিং ক্রস এবং টাওয়ার অফ লন্ডনের ঘাট থেকে। সুজানে ও উজানে দু’দিকেই প্রভূত দ্রষ্টব্য, দিনে -রাতে একাধিক ট্যুর। বিশেষ বিশেষ জাহাজে দুপুরের লাঞ্চ ও নৈশভোজের আয়োজন থাকে।

টাওয়ার অফ লন্ডন এক ইতিহাস। কত না শিরচ্ছেদের রক্ত রয়েছে এখানে। যেমন – অ্যান বোলিন, রেলে, এসেস আরও কতজনের ! কত না লুন্ঠিতরত্ন এখানে রক্ষিত। কোহিনূর, স্টার অফ ইন্ডিয়া -ইত্যাদি।

বাকিংহাম প্যালেস হল রাজার লন্ডনের বাসস্থান।

প্রাসাদের অন্তপুরে প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু কিং -কুইন্স গ্যালারিটি টিকিট কেটে দেখা যায়।

আরও পড়ুন: স্কটল্যান্ডে বাংলার প্রতিধ্বনী

লন্ডনের গ্রেট রাসেল স্ট্রিটে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ লাইব্রেরি। এখানে রয়েছে মিশরীয়, গ্রিক ও যাবতীয় প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতার অতুল সংগ্রহ।

ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামও কম আকর্ষণীয় নয়।

আগস্টে লন্ডন গোলাপের গন্ধে মউমউ করে। লন্ডন যত সবুজ, বোধ হয় পৃথিবীর আর কোনো মেট্রোপলিস ততটা নয়। ১৭৪ বর্গকিলোমিটার শুধু পার্ক আর ময়দান। হগর্থ হাউজের বাগান, কবি কিটসের বাড়ি, হ্যামপস্টেড হিথ –

এসব লন্ডনেই।

যে কয়টি নিদর্শন লন্ডন শহরকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্রিটিশ জাদুঘর। লন্ডন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ জাদুঘর, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় জাদুঘরে প্রবেশের জন্য।

ব্রিটিশরা এটি তাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর বলে থাকে। ৭ লাখের বেশি বিভিন্ন বস্তু এ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

পর্যটনের ভিত্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং যুক্তরাজ্যের প্রথম জাদুঘর এটি। প্রতিবছর এই জাদুঘরে আনুমানিক ৬০ লাখ দর্শনার্থী পরিদর্শনে আসেন। জাদুঘরের অধিকাংশ জিনিসপত্র পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী স্যার হ্যানিস স্লোত্রন সংরক্ষণ করেছিলেন। স্যার হ্যানিস স্লোত্রন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সার্বজনীন জাদুঘর হিসেবে। স্যার হ্যানিস প্রথমে ৭১ হাজার জিনিসপত্র সংরক্ষণ করেন, সে গুলোর মধ্যে ৭০ হাজার পান্ডুলিপি, ৪০ হাজার বই এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ নমুনা যার মধ্যে ছিল ৩৩৭ ধরনের গাছের ছবি।

ব্রিটিশ জাদুঘরটি ছিল প্রথম নতুন ধরনের জাদুঘর যা শুধু রাজা -রানী -রাজপুত্তুর -রাজকন্যাদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল সবকিছু সংরক্ষণ করা। বর্তমানে এটি প্রাকৃতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ জাদুঘর। এ জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত রয়েছে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি প্রত্নতত্ত্ব।

লন্ডনের এ জাদুঘর আধুনিকতাবাদী শিল্পের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনাগার।

রোমান যুগের আগে থেকেই লন্ডন তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। সেই পরিখা, দেওয়াল, দুর্গ, সেতু সবই অক্ষত আছে। রিজেন্ট স্ট্রিটে আছে বড় বড় স্ট্রিপার্টমেন্ট স্টোর। জার্মান স্ট্রিটে পৃথিবীর সেরা চীজের দোকান প্যাক্সটন অ্যান্ড হুইটফিল্ড। সব কথার শেষ কথা, ‘লন্ডনে যাহা চাও তাহা পাবে হেথা যাও।’

তবে লন্ডনের একেকটা স্থানের একেকরকম মাহাত্ম্য।

Leave a Comment