স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত একটি রাজ্য। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড- এই চারটি রাজ্য নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত।
বিশ্বের পরিব্রাজকদের কাছে স্কটল্যান্ড খুবই আকর্ষণীয় একটি স্থান। একজন পরিব্রাজকের দৃষ্টিতে স্কটল্যান্ডকে তুলে ধরেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন।
Table of Contents
- এডিনবরা –
- গ্ল্যাসগো –
- অ্যাবারডিন –
- ইনভারনেস –
- ডান্ডি –
- বনিব্রিজ –
- বেন নিভিস –
তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি – ১৯৬৮ সালের কথা।
ঢাকার গুলিস্তান এলাকার একটি বারে বসে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে দু’এক প্যাক সুরাটুরা খাচ্ছিলাম। আমাদের পাশের টেবিলে বসা এক যুবক ওয়েটারকে বললো, ‘দুই প্যাক স্কচ হুইস্কি দাও।’ সেই সন্ধ্যা রাতে ঐ ভদ্রলোকের কাছ থেকে স্কচ হুইস্কির বেশ একটা প্রশংসা শুনেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, স্কচ হুইস্কি স্কটল্যান্ডের সুরা। এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। স্কটল্যান্ডের জাতীয় পানীয় হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে স্কচ হুইস্কি।
স্কচ হুইস্কি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও মানসম্পন্ন হুইস্কি। এটি ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পানি হিসেবে স্বীকৃত। স্কচ হুইস্কিটি এলিটের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। যা কি-না এডিনবরা কাসল থেকে এই বিখ্যাত স্কচ হুইস্কির সঙ্গে পরিচিতি পেতে শুরু হয়েছিল। সেই স্থানে রয়েছে একটি দুর্গ – পরবর্তীতে এই স্থানটি হুইস্কি হেরিটেজ সেন্টারের মর্যাদা পায়। এখানে অনেকেই যান এবং স্কটরা হুইস্কির সেই ঐতিহ্যের কথাগুলি পর্যটকদের শুনিয়ে থাকেন।
ভদ্রলোকটির মুখে শুনেছিলাম, স্কটল্যান্ড হলো গলফ খেলার জন্মস্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গলফ খেলা সর্বপ্রথম স্কটল্যান্ডে শুরু হয় – যা কিনা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
কথায় কথায় ভদ্রলোকটি বললেন, ঢাকার ইস্কাটন এলাকার নাম হয়েছে কিন্তু স্কটল্যান্ডের একটি বিকৃত সংস্করণ থেকে ঘুরেফিরে। ভারত -বাংলায় যখন ব্রিটিশ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব করছিল ঠিক সেই সময়ে একটি গির্জা ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কটল্যান্ডের খ্রিস্টানদের দ্বারা সেই গির্জাটি স্থাপিত হওয়ার কারণে পরবর্তীতে ঢাকার ইস্কাটন এলাকাটির নাম স্কটল্যান্ড হলেও পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে ইস্কাটন নাম হয়েছিল। এখন তো সবাই আদর করে বলেন ‘ইস্কাটন গার্ডেন’। অথচ গার্ডেনের দেখাসাক্ষাৎ নেই। কিন্তু স্কটিশদের দেশ স্কটল্যান্ডে গার্ডেনের কোনো অভাব নেই। সবুজের সমারোহ রয়েছে ইউরোপ মহাদেশের স্কটল্যান্ডে।
স্কটল্যান্ডের মোট আয়তন ৭৮,০৮০ বর্গকিলোমিটার।
প্রায় আটশো দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে স্কটল্যান্ড দেশটি। তাছাড়া এই দেশে রয়েছে রাজপ্রাসাদের ছড়াছড়ি। এর সংখ্যা কম করে হলেও তিন হাজারের কম নয় ।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী বসেছে এডিনবরায়। তবে এডিনবরা স্কটল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সবচেয়ে বড় শহর হল গ্লাসগো। পৃথিবীর প্রাচীনত বৃক্ষের ছড়াছড়ি এই স্কটল্যান্ডে। তবে বেশি প্রাচীনতম গাছটির নাম ফরটিঙ্গাল ইয়েউ – গাছটির বয়স বর্তমানে প্রায় তিন হাজার বছর। ফরটিঙ্গাল ইয়েউ গাছটি স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ারে অবস্থিত। কেউ কেউ স্কটল্যান্ডকে ‘আলবা’ নামে ডাকে।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের কিছু মানুষ গুহায় বসবাস করত। কিন্তু সে বছরই আইন করে গুহায় বসবাস করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পৃথিবীর প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফ তোলা হয়েছিল টারটান রিবনে। যে জন্য যারা স্কটল্যান্ড ভ্রমণে আসেন তারা একটিবারের জন্য হলেও উঁকি দেন টারটান রিবনে।
স্কটল্যান্ডের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান –
এডিনবরা –
এডিনবরাকে এডিনবার্গও বলা হয়। এটি স্কটল্যান্ডের ৩২টি কাউন্সিল অঞ্চলের একটি। রাজধানী শহর এই এডিনবরায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ফায়ার ব্রিগেড বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যা কি-না কাছ থেকে দেখা যায়। প্রধান আকর্ষণগুলির একটি হল ফোর্ট ব্রিজ – এটি স্কটল্যান্ডের উত্তরে এডিনবরাকে যুক্ত করার জন্য ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। এডিনবরা কাসল একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপরে অবস্থিত। এটি না দেখে কেউ এডিনবরা থেকে চলে যান না। যারা এডিনবরা যান তারা এখানে একবার আসবেনই। মুলত এটি দুর্গ। এই দুর্গের দেওয়ালগুলি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রতিরোধের প্রধান প্রাচীর ছিল। এটি দেখে ট্যুরিস্টরা অভিভূত হয়ে পড়েন।
এডিনবরা শহরের আয়তন ২৬৪ বর্গকিমি। এক নজরে এডিনবরার দর্শনীয় হল – এডিনবার্গ কাসল, জাতীয় মিউজিয়াম, হলিরুড হাউজ, রয়েল বোটানিক গার্ডেন, রয়েল মাইল বা প্যালেস, দুর্গ, স্মৃতিস্তম্ভ, হলিরুডহাউসের প্রাসাদ, ক্যাল্টন পাহাড়, প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেন, বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট জিলস ক্যাথেড্রাল।
আঠারো শতকে স্কটিশ নব জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এডিনবরা – যা স্কটল্যান্ডকে ইউরোপে বাণিজ্যিক এবং শিল্প শক্তিকেন্দ্রগুলোর একটিতে রূপান্তরিত করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বৃহত্তম তেল মজুদ রয়েছে এই এডিনবরায়। এজন্যই এডিনবরাকে ইউরোপের তেল রাজধানী বলা হয়। আর স্কটিশদের কাছে এটি হচ্ছে সিলভার সিটি উইথ দ্য গোল্ডেন স্যান্ড।
গ্ল্যাসগো –
গ্ল্যাসগো স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম শহর। অন্যতম পর্যটন নগরী এটি। এই শহরে রয়েছে সায়েন্স সেন্টার। এটি মিউজিয়ামও বটে। মিউজিয়াম ভবনটি আধুনিক উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই মিউজিয়ামে একবার ঢুকলে সহজে বের হতে মন চাইবে না। এই মিউজিয়ামে সব বয়সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আকর্ষণ রয়েছে। গ্লাসগোতে আরও দেখা যাবে – সেন্ট মুগোয়ের ক্যাথিড্রাল, হান্টারিয়ান মিউজিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা।
অ্যাবারডিন –
এটি স্কটল্যান্ডের উত্তর -পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী একটি শহর। উত্তর সাগর ও ডন নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এটি শিল্পকেন্দ্র স্থান হিসেবে খ্যাত। একসময় অ্যাবারডিন শহরটি গ্রাম্পিয়ন অঞ্চলের রাজধানী ছিল। এটি স্কটল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া এ শহরটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ও সর্ববৃহৎ মৎস্য বন্দর। এখানে দেখার আছে – মেরিশাল কলেজ, ওয়েস্ট টাওয়ার, অ্যাবরডিন সমুদ্র সৈকত।
ইনভারনেস –
ইনভারনেস শহরকে বলা হয় সাংস্কৃতিক শহর। এখানে রয়েছে দুর্গ, প্রাসাদ, মিউজিয়াম, কাসল, নেস আইল্যান্ড, বোটানিক গার্ডেন, নেস ওয়াক, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তি।
ডান্ডি –
এখানে বহু শিল্প কলকারখানা রয়েছে। ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। একসময় ডান্ডি থেকে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করত বিভিন্ন পণ্য আনা নেওয়ার জন্য। এজন্য নারায়নগন্জকে বাংলাদেশের ডান্ডি বলা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পাট এবং পাটজাত সামগ্রী ডান্ডিতে রপ্তানি করা হয়।
বনিব্রিজ –
এই শহরটি থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এলিয়েন মহাকাশযান দেখা যায়। তবে বনিব্রিজ শহরটি আয়তনের দিক দিয়ে খুব ছোট। এর আশেপাশে রয়েছে স্বাদু পানির হ্রদ।
স্কটল্যান্ড ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: এডিনবরার সাউথ কুইন্সফেরীর নৌবিহারে
বেন নিভিস –
এটি হল পর্বত। এই পর্বতটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড়। বেন নেভিস পাহাড়ের উচ্চতা ৪ হাজার ৪০৯ ফুট।
স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হল ‘হ্যাগিস’। এ খাবারটি তৈরি করা হয় ভেড়ার হৃৎপিণ্ড, যকৃত ও ফুসফুস একসঙ্গে মিলিয়ে। যা কি-না দীর্ঘক্ষণ সেদ্ধ করতে হয়। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত পানাশালাটিতে অনেকেই যান – এক মাইল পাথুরে পথ হাইকিং করে সেখানে পৌঁছানো যায়।
গ্রেট ব্রিটেনের উত্তর দিকের এক তৃতীয়াংশে স্কটল্যান্ড অবস্থিত। এর দক্ষিণ -পূর্বে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৯৬ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত, উত্তর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর -পূর্বে উত্তর সাগর এবং দক্ষিণে আইরিশ সাগর অবস্থিত।