মহামারীর প্রতীককে ভালবাসা দিন

শকুনকে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর এবং মহামারীর প্রতীক হিসেবে ভাবা হলেও এই দুর্লভ পাখিকে এখন আর আগের মতো দেখা যায় না।

কত শহর -গ্রাম ঘুরে নবীনদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, তারা কেউই এ পর্যন্ত শকুন চোখে দেখেনি। শকুনের গল্পও শোনেনি। কারণ এ-ও তো হতে পারে, বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। চোখে না দেখুক, বই না পড়লে শকুনকে চিনবেই বা কেমনে।

সেই কবে নদী পথে নৌকায় মায়ের সঙ্গে গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার সময় একসঙ্গে কয়েকটি শকুন দেখার সেই স্মৃতি আজও ভাসা ভাসা মনে পড়ে।

বাংলাদেশে শকুন বোধহয় নেই, তবুও দু’চারটে থাকলেও থাকতে পারে। তবে থাকবেই বা কেমনে। প্রতিনিয়ত মানুষ গাছপালা কেটে ফেলার কারণে শকুনের মতো বহু প্রজাতির পাখি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

প্রকাশ, সম্প্রতি ভারতের অসম রাজ্যের দরং জেলায় এপর্যন্ত ১৪ টি শকুনের মৃতদেহ পাওয়ায় প্রকৃতি প্রেমীরা নিজেদের বিচলিত বোধ করছেন। কারণ, এই দুর্লভ প্রজাতির পাখিদের সংরক্ষণের জন্য সাধারণত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

দরং জেলার পাথরি ঘাট রাজস্ব চক্রের অন্তর্গত আন্ধেরিঘাট সংলগ্ন কাহিতলিতে অসহায় অবস্থায় একটি বড় শকুন উদ্ধার করা হয়। সংলগ্ন সুতি নদীর ধারে এই শকুনটিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। শকুনটি উড়তে পারছিল না। স্থানীয় দু’জন প্রকৃতি প্রেমী সাংবাদিকদের মাধ্যমে এই শকুন উদ্ধার করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

পরে বন বিভাগের সহায়তায় শকুনটিকে অসমের এক চিড়িয়াখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

এদিকে এই এলাকার হুসেইন সুবুরিতে এর পরপরই মৃত অবস্থায় ৯ টি শকুন এবং মুমূর্ষু অবস্থায় আরও ৪ টি শকুন উদ্ধার করে বন বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে ওই ৪ টি শকুনেরও বন বিভাগের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয়।

এ ব্যাপারে পশু প্রেমীদের দাবী, এ অবস্থায় বন বিভাগের উচিত, খুঁজে খুঁজে শকুন বের করে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে । শকুন যেন বিপন্ন না হয় এটা দেখার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, ভীষণ উপকারী পাখি শকুন। মৃত পশুর দেহ হচ্ছে শকুনের প্রধান খাদ্য। শবদেহ খেয়ে যেভাবে তারা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে, সেজন্যে তাদের প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবেই স্বীকৃত।

আরও পড়ুন: যে শহরে পায়রা মনোরঞ্জন করে 

ছিঁড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয়

রহস্যে ঘেরা কামরূপ কামাক্ষ্যা

বৌদ্ধ এবং জারোয়াসথ্রিয়ান ধর্মের অনুসারীরা তাদের কেউ মারা গেলে সেই দেহও ফেলে রাখে শকুনের জন্য। শকুন এসে এই দেহ খেয়ে ফেলে। এ প্রসঙ্গে জানা যায়, এই রীতিকে সেখানে আকাশে কবর দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়। উঁচু পার্বত্য এলাকায় মৃতদেহ কবর দেওয়া কিম্বা দাহ করার মতো জ্বালানি কাঠ পাওয়া বেশ কঠিন। কাজেই সেখানে সহজ কাজ হচ্ছে মৃতদেহ এভাবে শকুনের জন্য ফেলে রাখা হয়। এসব ধর্মীয় রীতিতে প্রিয়জনের মরদেহ শকুনের খাদ্য হিসেবে দান করার কাজটিকে বেশ পবিত্র বলেও গণ্য করা হয়। তাদের ধর্ম অনুযায়ী, শকুন যখন দেহটি খেয়ে ফেলবে, তখন আত্মা দেহ থেকে মুক্তি পাবে।

সুতরাং বৌদ্ধ এবং জারোয়াসথ্রিয়ান ধর্মের মানুষদের প্রয়োজনের কারণে শকুন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে শকুন বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হবে। সব থেকে বড় প্রয়োজন, মানুষ নিঠুর না থেকে যেন শকুনদের প্রতি একটুকু ভালোবাসা দেখাক। তবেই শকুন প্রেমীরা সন্তুষ্ট হবে, পাবে আত্মতৃপ্তি। সেই সঙ্গে আরও বেশি সন্তুষ্ট হবে বৌদ্ধ ও জারোয়াসথ্রিয়ান ধর্মাবলম্বীরা।
এদিকে সকল দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন হওয়ার পাশাপাশি চাই জনগণেরও সচেতনতা।

লিয়াকত হোসেন খোকন: লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক।

Leave a Comment