প্রাচীন মারি শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ২৩ শতকে আক্কাদিয়ানদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল, পরবর্তীতে শহরটিকে পুনর্নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন একজন সামরিক গভর্নর। আক্কাদিয়ানদের সাম্রাজ্যের বিচ্ছিন্নতার সাথে গভর্নররা স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং ইউফ্রেটিস উপত্যকার একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে শহরটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
এই মারি শহরটি সিরিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত।
মারি ছিল আধুনিক দিনের সিরিয়ার একটি প্রাচীন সেমেটিক নগর রাষ্ট্র। এর অবশেষ ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে আবু কামাল থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ -পূর্বে। এটি ২৯০০ খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭৫৯ খৃষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র এবং আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বিকাশ লাভ করে। শহরটি ইউফ্রেটিস বাণিজ্য পথের মাঝখানে সুমেরের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
মারি ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে ইরাকি সীমান্তের কাছে সিরিয়ার পূর্ব প্রান্তে আবিস্কৃত হয়েছিল। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে ২০১১ খৃষ্টাব্দ থেকে এখানের খনন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় আর আরম্ভ হয়নি। এই মারি শহরটি সশস্ত্র গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণে আসে, আর তখন থেকেই ব্যাপকভাবে লুটতরাজ চলে এখানে।
সশস্ত্র গ্যাংরা রাজপ্রাসাদ, পাবলিক স্থান, ইশতার মন্দির সহ বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়।
কিউনিফর্মে লেখা শহরটির নাম মের থেকে পাওয়া যায়। উত্তর মেসোপটোমিয়া এবং সিরিয়ার একটি প্রাচীন ঝড় দেবতা, যাকে শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা বলে মনে করা হত। এ প্রসঙ্গে জর্জেস ডসিন বলেছেন, শহরের নামটি ঝড়ের দেবতার সাথে অভিন্নভাবে বানান করা হয়েছিল। যা কিনা ঝড়ের দেবতা মেরের থেকে পরবর্তীতে মারি হয়েছিল।
মারি নামে আরেকটি স্থান –
মারি নামের এ স্থানটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালী জেলার একটি শহর ও ইউনিয়ন পরিষদ। এটি পুরনো মারি সিন্ধু নামেও পরিচিত হয়।
সিন্ধু নদী থেকে এই মারির দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। এই মারি অঞ্চলটি হিন্দু সভ্যতার ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের জন্য বিখ্যাত।
চুয়ান্ন বছর আগের মারি স্মৃতি –
মারী হল পাহাড়ের রানী। সমতল ভূমি থেকে মারীর উচ্চতা ২,২৯১ মিটার বা ৭,৫১৬ ফুট। নতুন গাড়ি, পাকা রাস্তা, সুন্দর পরিবেশ, সূর্যের তেজ – এ রকম অবস্থায় আমি ও আমার পাঞ্জাবি বন্ধু ইকবাল দু’জনে মিলে মারী পাহাড়ের দিকে ছুটলাম।
সেই বছরটা ছিল ১৯৬৮ খৃষ্টাব্দ। তখন আমি কলেজের ছাত্র। ইকবালও আমার সমবয়সী।
পাঞ্জাবি বন্ধু ইকবাল কথায় কথায় বলেছিল, ইসলামাবাদ থেকে মারীর দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার।
দেখলাম, মাইলের পর মাইল পথের দুই পাশে ছায়াদার গাছ, কেবল একেক সারি গাছ নয়, প্রত্যেক পাশে তিন -চার সারি গাছ।
দূরন্ত বাতাস, গাড়িও আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠছে। ভয় ভয় লাগছিল।
ইকবালকে জড়িয়ে ধরে বারবার মনে হয়েছিল, এই বুঝি গাড়ি পিচ্ছিল খেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। ইকবাল আমার হাত ধরে বলেছিল, ভয় কিসের। দু’জন না হয় একসঙ্গে মরবো।
ওর কথা শুনে এতটুকু বিচলিত হইনি। মারীতে যাচ্ছি , এরচেয়ে আর কী আনন্দ হতে পারে।
রূপালী পর্দায় শামীম আরা, সাবিহা, জেবা, হুসনা, নাসিমা খান, সুলতানা জামান, শবনম, রাণীকে বিভিন্ন নৃত্য দৃশ্যে মারীর পাহাড়ে দেখেছি।
পূর্ব দিকে তাকাতেই দেখি কয়েকটি উট। তার পিঠে চড়ে লাকড়ির বোঝা বয়ে চলেছে একটি মেয়ে।
রাভী ও চেনাব নদী পার হয়ে গাড়ি চললো। যতই এগিয়ে চললাম, ততই অনুর্বর ভূমির সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে লাগলো।
গাড়ি চলছে পাহাড়ের গা বেয়ে – এদিকে ইকবাল আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ঐ যে ঝিলাম নদী।
নদীর পরেই লালমাটির দেখা পেলাম। অনাবাদি সে মাটি, বুকে তার আবাদের একটুকুও চিহ্ন নেই। যে দিকে চোখ যায় দেখি পাহাড়, টিলা।
সেই পাহাড়ের অরণ্যে বাস করে হায়েনা, নেকড়ে, চিতাবাঘ ও হরিণ সহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।
ঝিলামের প্রাচীন ইতিহাস বিচিত্র। পাণ্ডবেরা এই ঝিলাম জেলায় এসে অনেক দিন ছিলেন। আলেকজান্ডারের সঙ্গে পুরুর যে লড়াই হয় তাও হয় এই ঝিলাম জেলায়। লড়াইটা হয়েছিল ঝিলাম শহর থেকে দশ মাইল উত্তর -পূর্বে।
গাড়ি ঘুরে গিয়েছিল বলে পথে রাওয়ালপিন্ডি শহরটিও দেখলাম। রাওয়ালপিন্ডি জেলার উত্তর – পশ্চিমে তক্ষশিলা অবস্থিত। আলেকজান্ডার এই তক্ষশিলায় এসেছিলেন। তখন তক্ষশিলা বিরাট ও সমৃদ্ধশালী শহর ছিল।
গজনীর সুলতান মাহমুদ শাহ আনন্দ পালকে পরাজিত করে এই রাওয়ালপিন্ডি জেলার ভেতর দিয়ে ফিরে যান। গাড়ি রাওয়ালপিন্ডি সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারসের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলছে। এবার আমরা সমতল ভূমি ছেড়ে ক্রমে পাহাড় বেয়ে চলছি। পথে একটি জায়গায় গাড়ি এসে থামলো। ওই জায়গার নাম দররা পানি।
ড্রাইভার বললেন, এখানে আপনারা নেমে কিছু খেয়ে নিন। মাত্র দশ মিনিট বিরতি।
ইকবাল ও আমি নেমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটি করে রুটির সঙ্গে উটের মাংস খেয়ে নিলাম। ইকবালের খাওয়া দেখে মনে হল, ও নিতান্ত তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে। হঠাৎ দেখি, রেস্টুরেন্টের সামনে ভিড় পড়ে গেছে। বীনবাদক বীণ বাজাতে লাগলো। কী মধুর গানের সুর। একটু অদূরে কোনো একটি ছবির স্যুটিং চলছে। সেই সময় অনেকটা কাছ থেকে নায়ক ওয়াহিদ মুরাদকে দেখলাম।
গাড়ি ছেড়ে দিবে, তাই ওয়াহিদ মুরাদের কাছে যাওয়া হলো না। গাড়ি ছেড়ে দিল। পথে ধান্নী কোহলা নামে জায়গা পড়ল। ড্রাইভার বললেন, এই ধান্নী কোহলা হয়ে মুজাফফরবাদে যাওয়া যায়। তখন বার বার তাকিয়ে দেখলাম, সেই পথের বাঁক।
ইকবালের মুখে শুনেছিলাম, মারী পাঞ্জাবের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত একটি পার্বত্য শহর।
মারী অঞ্চলটি লাহোর থেকে প্রায় ২০০ মাইল সোজা উত্তরে অবস্থিত। মারী থেকে মুজাফফরাবাদের দূরত্ব ৫০ মাইল।
প্রায় দুই ঘন্টা পরে আমরা মারীতে এসে পৌঁছলাম। মারীর ইমতিয়াজ শহীদ রোডের সিলির হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। প্রচণ্ড শীতে আমরা জড়সড়।
মারীকে বলা হয় শৈল শহর। এই শহরে রয়েছে হোটেলের ছড়াছড়ি। লরেন্স কলেজ রোডের সাংগিরিলা হোটেল ; হল রোডের হোটেল গ্র্যান্ড হাইটস ; লরেন্স কলেজের কাছাকাছি ব্লু পাইনস ইন প্রভৃতি হোটেলের কথা এখনও ভাসা ভাসা মনে পড়ে।
মারীতে এসে শুধুই চোখে পড়ল পাইন গাছ আর পাইন গাছ। এগুলো দেড়শো হাতের কম লম্বা নয়।উপরে রয়েছে ঘন পত্রময় শাখার মতো ছাতা। পাইন গাছের দিকে তাই শুধু তাকিয়ে রইলাম আমি ও ইকবাল।
মারী হিমালয়ের অংশবিশেষ। শহর মারী পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। দু’জনে হাতে হাত রেখে যেদিকে আগাচ্ছি সেদিকে দেখি কেবল গাছ, কত না পাইনের অফুরন্ত সুন্দর শাখা প্রশাখা।
ইকবাল আমাকে বুকে জড়িয়ে বললো, বন্ধু, দেখো ওই যে কাশ্মীরের শুভ্র তুষারাচ্ছন্ন পর্বত শিখর, আরও দেখ – নাংগা পর্বতের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। তখন শুধুই যে তাকিয়ে থাকা।
ইকবাল আর আমি তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাখতে দ্বিধাবোধ করিনি। আমরা দু’জন ছিলাম সমবয়সী – কয়েকটি দিন একত্রে থেকে কত না ধরনের আনন্দে ডুবে ছিলাম। সেই দিন আর ফিরে আসবে না – সে তো চুয়ান্ন বছর আগের ঘটনা।
সেই সময় ইকবাল দেখতে দারুণ সুন্দর ছিল, আর আমিও কম ছিলাম না।
আরও পড়ুন: যে দেশে দুই বিয়ে না করলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড!
যেখানে মৃত মানুষের আত্মা দুর্ঘটনা ঘটায়
মারীর আরেক নাম মুরী। মারী অর্থ চূড়া। পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি জেলার পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের গালাত অঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্বত উপকূলীয় শহর। এটি ইসলামাবাদ -রাওয়ালপিন্ডি মহানগর এলাকার সীমানা গঠন করে এবং ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে অবস্থান করছে।
বর্তমানে মারী শহরটি রাওয়ালপিন্ডি জেলার অন্তর্গত।
১৮৫১ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য একটি স্বাস্থ্য নিবাস হিসাবে মারী বা মুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে মারীকে স্থায়ী শহর হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এখানে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। এখানকার একটি প্রধান সড়ককে সাধারণত আধুনিক সময়ের মধ্যেও উল্লেখ মল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মারী – শিমলা যাওয়ার পথের ঔপনিবেশিক পাঞ্জাব সরকারের গ্রীষ্মকালীন সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
-লিয়াকত হোসেন খোকন